শুরু থেকেই করোনাভাইরাসকে ফুসফুসে সংক্রমণ সৃষ্টিকারী রোগ হিসেবে ধারণা করা হলেও ভাইরাসটি শরীরের একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকেজো করে দিতে পারে বলে মনে করছেন মার্কিন বিশেষজ্ঞরা। করোনা আক্রান্তদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্তের ঘনত্ব বৃদ্ধি ও জমাট বাঁধার মতো কয়েকটি নতুন বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করেছেন তারা।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে এমন তথ্য।
নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের করোনা আক্রান্তদের পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, তাদের ফুসফুসের একটি অংশ অস্বাভাবিকভাবে রক্তশূন্য হয়ে পড়ছে। হাসপাতালের কিডনি বিশেষজ্ঞরা জানান, কিডনি ডায়ালাইসিস ক্যাথেটারে রক্ত জমাট বেঁধে থাকতে দেখা যাচ্ছে। স্নায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্ত জমাট বাঁধার কারণে স্ট্রোকের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তরুণদের মধ্যে অনেকেই স্ট্রোক করছেন। যারা স্ট্রোক করেছেন তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই করোনায় আক্রান্ত।
হাসপাতালটির নিউরোসার্জন ডা. জে. মকো বলেন, ‘এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে কোভিড-১৯ রক্ত জমাট বাঁধতে অস্বাভাবিক ভূমিকা রাখছে। অনেক বিশেষজ্ঞরাই এটাকে এখন শুধুমাত্র ফুসফুসের রোগের চাইতেও বেশি বলে মনে করছেন।’
তিনি জানান, কয়েকজন তরুণের ক্ষেত্রে প্রথম উপসর্গই ছিল স্ট্রোক।
বিশেষজ্ঞদের এমন পর্যবেক্ষণের পর রক্ত জমাট বাঁধার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন চিকিৎসকরা। করোনা রোগীর চিকিৎসায় নতুন নিয়ম তৈরি করেছেন তারা। রক্ত জমাট বাঁধার কোনো লক্ষণ দেখার আগেই করোনা আক্রান্তদের উচ্চমাত্রায় রক্ত লঘু করার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালটির সভাপতি ডা. ডেভিড রেইখ বলেন, ‘রক্ত জমাট বাঁধা আটকানো গেলে হয়তো রোগটির ভয়াবহতা কিছুটা কমে আসতে পারে। তবে, এখনো বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি। তাই উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের চিকিৎসায় নতুন নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে না।’
তিনি জানান, জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে এটা করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে।
মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে তিন সপ্তাহে ৩২ জন স্ট্রোক করা রোগীকে দেখেছেন নিউরোসার্জন ডা. জে. মকো। এই রোগীদের মস্তিষ্কে অস্বাভাবিকভাবে জমাট বাঁধা রক্ত দেখেছেন তিনি।
মকো জানান, এই তিন সপ্তাহে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ সংখ্যক রোগী এসেছে। পাঁচ জনের বয়স ছিল ৪৯ বছরের নিচে। সবচেয়ে কম বয়সী রোগীর বয়স ৩১ বছর। তারা কেউই স্ট্রোকের ঝুঁকিতে ছিলেন না।
ফুসফুস বিশেষজ্ঞ ডা. হুম্যান পোর জানান, হাসপাতালে ১৪ জন করোনা রোগীকে ভেন্টিলেটর সেবা দিতে গিয়ে অবাক হয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সাধারণত নিউমোনিয়ায় যেমন হয়, এই রোগীদের ফুসফুস তেমনটা শক্ত হয়ে যায়নি। বরং মনে হচ্ছিল, ফুসফুসের মধ্যে রক্তের প্রবাহ ঠিক ভাবে হচ্ছে না।’
হাসপাতালের কিডনি বিশেষজ্ঞ ডায়ালাইসিস ক্যাথেটারে রক্ত জমাট বেঁধে থাকতে দেখেন।
ইস্টার সানডের রাত তিনটার দিকে নিউরোসার্জন ডা. জে. মকোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন ফুসফুস বিশেষজ্ঞ ডা. হুম্যান পোর। এরপর চিকিৎসকরা আলোচনায় বসেন।
মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের ১৯ জন করোনা রোগীর রিপোর্টের পাশাপাশি চীনের হুবেই প্রদেশসহ অন্যান্য অঞ্চলের করোনা আক্রান্তদের রিপোর্ট সংগ্রহ করেন তারা। অন্যান্য অঞ্চলের রোগীদের ক্ষেত্রেও একইরকম বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এরপরই তারা করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য নতুন নিয়ম তৈরি করেন।
ফিলাডেলফিয়ার থমাস জেফারসন ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের চিকিৎসক পাস্কাল জ্যাব্বারও করোনা আক্রান্তদের মধ্যে স্ট্রোকের প্রবণতার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আমি এর আগে কখনো কোনো ভাইরাসের আক্রমণে এ রকম কিছু হতে দেখিনি।’
করোনা রোগীর রক্ত জমাটের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে আমেরিকান সোসাইটি অফ হেমাটোলজি। তবে একটি নির্দেশিকায় তারা জানিয়েছে, করোনা আক্রান্তদের রক্ত জমাট বাঁধার উপসর্গ আছে কিনা এখনো তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই, তাদের রক্ত লঘু করলে চিকিৎসায় সুবিধা হবে কি না সেটা এখনই নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না।
রাজধানীসহ সারাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকরাই আক্রান্ত হচ্ছেন প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে। শীর্ষে ঢাকা ।
ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিজের (এফডিএসআর) তথ্য অনুযায়ী, রোববার (২৬ এপ্রিল) পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগে মোট ৩৭১ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে ৩০৫ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন।
অন্য বিভাগগুলোর মধ্যে- বরিশালে ৯ জন, চট্টগ্রামে ১৫, সিলেটে ৫, খুলনায় ১০, রংপুরে তিন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ২৪ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হন।
ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিজ নামক একটি সংগঠনটি সারাদেশের চিকিৎসকদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরিসংখ্যান তুলে ধরছে।
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৪৫ জনে। আক্রান্ত হিসেবে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন আরও ৪১৮ জন। এতে দেশে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৪১৬। এছাড়া নতুন করে সুস্থ হয়েছেন আরও নয়জন। ফলে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ১২২ জনে।
করোনাভাইরাসের থাবায় যখন সবাই দিশেহারা হয়ে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের দিকে চেয়ে আছে, ঠিক সেই সময়ে চট্টগ্রামের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউএসটিসির অধীন বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতাল থেকে ১৯ জন নার্স এবং ১১ জন ক্লিনার ও ৪ জন আয়াকে আকস্মিক চাকরিচ্যূত করেছে কর্তৃপক্ষ। চাকরিচ্যূতির কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে ‘কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে’।
চাকুরিচ্যুত করার প্রতিবাদে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি)’ প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীরা। রোববার (২৬ এপ্রিল) সকাল ১০টার দিকে হাসপাতালের সামনে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা।
জানা গেছে, গত ৮ এপ্রিল ১৯ জন নার্স এবং ১৫ জন আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে নোটিশ বোর্ডে বিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রতিষ্ঠানটি। নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে প্রথমে বেতন ভাতাও আটকে দেয় কর্তৃপক্ষ। পরে অবশ্য বেতন পরিশোধ করা হলেও চাকুরিচ্যুত করার নির্দেশনা জারি রাখা হয়।
ইউএসটিসি কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. সোলায়মান চট্টগ্রামের একটি গণমাধ্যমে বলেন, ইউএসটিসিতে কোন শৃঙ্খলা নেই। এখানে দুই বার দুইজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডিরেক্টর হিসেবে এসেছিলেন। মালিকপক্ষের এসব অনিয়মের কারণে উনারা চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। এরপর থেকে মালিকপক্ষ তাদের পোষা লোকজনকে চেয়ারে বসায়, যাদের কোন ব্যক্তিত্ব নেই। মালিকের কথায় উঠবে, বসবে। এখন তারা অভিজ্ঞ নার্স, আয়া, স্টাফদেরকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বিদায় করার নোটিশ দিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাতে অনেককে চাকরিচ্যূত করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ৮ এপ্রিল চাকরিচ্যূতির নোটিশে আমরা অবাক হয়েছি। নোটিশে কোন কারণ উল্লেখ করা হয়নি। এভাবে কাউকে চাকরিচ্যূত করা যায় না। চাকরিচ্যূতদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমরা এর প্রতিবাদে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, নগর পুলিশের কমিশনার, জেলা প্রশাসক, খুলশী থানাসহ, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি দিয়েছি। করোনা পস্থিতিতে আমরা এই মুহুর্তে আন্দোলনে যেতে না পারলেও আমরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে অগ্রসর হবো।
চাকরিচ্যূত নার্স হামিদা আক্তার বলেন, ‘আমরা ডিপ্লোমাধারী না হলেও আমাদের দিয়েই ইউএসটিসি সৃষ্টি। সরকারতো ডিপ্লোমা ছাড়া নার্স নিয়োগ দিতে নিষেধ করেছে। আমাদেরকে তো চাকরি থেকে বাদ দিতে বলেনি।’
চাকরিচ্যূতির শিকার আরেক নার্স রেহানা আক্তার বলেন, ‘আমার চাকরির বয়স ১৯ বছর। আমি বাইরে ডিপ্লোমা করেছি। নার্সিং কাউন্সিলের নাম্বার ছিল না। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা করেছি তাদের নাম্বার ছিল। সেটা ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেনি।’
এদিকে হাসপাতালের পরিচালক ডা. কামরুল হাসান গণমাধ্যমকে জানান, আমাদের মোট ৭৮ জন নার্স কর্মরত আছেন। যাদের বিদায়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী তাদের যোগ্যতায় ঘাটতি আছে। আগ থেকেই এদের নিয়োগ নিয়ে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আপত্তি ছিল। গত ডিসেম্বর থেকে তাদের বিদায় দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিপরীতে ডিপ্লোমাধারী ২২ জন নার্স আমরা নিয়োগও দিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, নার্স-আয়া-স্টাফ মিলে যে ৩৪ জনকে বিদায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে তাদের যাবতীয় পাওনা দিয়ে আমরা বিদায় দিচ্ছি। তাদের যে এসোসিয়েশনগুলো আছে ওগুলোর সাথে আমরা আগে বসেছি, তাদের সাথে বসেছি যে তারা কোন শর্তে যে চায়। সে সব শর্ত মেনেই তাদের আমরা বিদায় দিচ্ছি। তারা যাবতীয় পাওনা নিয়েই যাবেন। আর একমাস সময় আমরা হাতে রেখেছি। এই এক মাসের বেতনও তারা পাচ্ছেন।
জানা গেছে, ইউএসটিসির বর্তমান চেয়ারম্যান মো. ইফতেখার ইসলাম প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের ছেলে। তার স্ত্রী ডা. সাবা কাশ্মীরের নাগরিক। ৬ মাস আগে একই প্রতিষ্ঠান থেকে এমবিবিএস পাস করে তিনিও ডিরেক্টর হিসেবে হাসপাতালে জয়েন করেছেন। এই আদেশের বিষয়ে অনেকে আঙ্গুল তুলছেন ডাঃ সাবা’uর দিকে। কিন্তু আরেক চিকিৎসক ওই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, এসব সিদ্ধান্ত চেয়ারম্যান, নার্সিং ইন্সটিটিউটসহ অন্য অথরিটির সম্মতিতে গ্রহণ করা হয়। একজনের ওপর চাপানোর কোন সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. মিনহাজুর রহমান বলেন, কোন কারণ দর্শানো নোটিশ এবং যৌক্তিক কারণ ছাড়া কথায় কথায় চিকিৎসক, নার্স স্টাফ চাকরিচ্যূত করা ইউএসটিসির জন্মগত স্বভাব। করোনা সংকটে তারা অসচ্ছল স্টাফদের চাকরিচ্যূত করাটা অন্যায়। আমরা এই আদেশ প্রত্যাহার চাই।
বিষয়টিকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন দাবি করে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ডেপুটি গভর্নর আমিনুল হক বাবু বলেন, করোনা সংকটে পুরো জাতি যখন একে অপরের পাশে দাঁড়াচ্ছে, সেখানে ইউএসটিসি তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ নার্স, স্টাফ ছাঁটাই করছে— এটা অমানবিক, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধও। কর্তৃপক্ষ চাকরিচ্যূতির এই আদেশ প্রত্যাহার না করলে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে দাঁড়াবে।
রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে শর্তসাপেক্ষে করোনা হাসপাতাল হিসেবে চালু করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরকে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
২৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সহকারী স্বাস্থ্য-১ শাখার উপসচিব মো. আবু রায়হান মিয়া স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তিনটি শর্তসাপেক্ষে হাসপাতালটিতে করোনাভাইরাসের চিকিৎসাসেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা জারি করা হয়।
শর্ত তিনটি হলো-
১. হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সাথে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে হাসপাতালটি শুধু করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য পরিচালিত হবে।
২. হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য পরিচালনা ব্যয় নির্ধারণ করা যাবে ৩. রোগীর চিকিৎসার ব্যয়বাবদ খরচ সরকার বহন করবে
করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যে কিট উদ্ভাবন করেছে, সেটা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর নেয়নি উল্লেখ করে কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্ট্রি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ব্যবসায়িক স্বার্থে জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে কাজ করছে। তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে গণস্বাস্থ্যের কিট গ্রহণ করেনি। আমরা জনগণের স্বার্থে শুধু সরকারের মাধ্যমে পরীক্ষা করে কিটটি কার্যকর কি-না, তা দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকারিভাবে প্রতি পদে পদে পায়ে শিকল দেয়ার চেষ্টা হয়েছে।
রোববার (২৬ এপ্রিল) বিকেল ৪টায় রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলনে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ কথা বলেন।
এর আগে শনিবার (২৫ এপ্রিল) বিকেলে একই জায়গায় করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ হস্তান্তর করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। আমন্ত্রণ জানানোর পরও যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার্স ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ছাড়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত এ কিট গ্রহণের জন্য যায়নি সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান। পরদিনই এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানান, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কার্যালয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের করোনা কিটের উদ্ভাবক ড. বিজন কুমার শীলসহ তিনজন এটি জমা দিতে যান। তবে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর তা গ্রহণ করেনি। এমনকি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের তিনজনের একজনকে ওষুধ প্রশাসনের কার্যালয়ে প্রবেশও করতে দেয়া হয়নি।
‘কর্তৃপক্ষ জমা নেবেন না। আমরা গিয়েছিলাম, তারা জমা নেননি। বললেন যে সিআরও নিয়ে আসেন। তারপরে বললেন, এটা আপনারা ভেরিফিকেশন করে আনেন সিআরও থেকে। সিআরও হলো চুক্তিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ওখানে পয়সা দিতে হবে। কত খরচ লাগবে, তা উনারা (সিআরও) বাজেট দেবেন। পরে আইসিডিডিআর,বি থেকে ভেরিফিকেশন করিয়ে আনার কথা বলেন। আইসিডিডিআর,বি লকডাউন থাকায় তারা বিএসএমএমইউ, আইইডিসিআর কিংবা আর্মি প্যাথলজি ল্যাবরেটরি থেকে কার্যকারিতা আছে কি-না পরীক্ষা করে দেখার প্রস্তাব দিলেও তা মানা হয়নি।’
তিনি বলেন, জাতির এ দুর্যোগের সময় যুগান্তকারী আবিষ্কার এ কিট কাজে লাগানো যাচ্ছে না। যেখানে ইরানে এ ধরনের কিট প্রতিদিন ১০ লাখ তৈরি ও ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানে তারা কিট জমাই রাখেননি। যে কোনো ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষাতে আপত্তি নেই। কিন্তু জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে তারা এখন বাজেট ঠিক করবেন, তারপর সিআরও’র মাধ্যমে রিপোর্ট নেবেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আপনাদের বুঝতে হবে, কিভাবে তারা ব্যবসায়িক স্বার্থকে রক্ষা করছেন। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর অনৈতিক কাজ করছে, দেশের ক্ষতি করছে। তারা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে রেখে চলেন, তাতে তাদের লেনদেনে সুবিধা হয়।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এ প্রধান বলেন, প্রথমে আমাদের বললো, অনুমোদন নেই দেখে আমরা আসতে পারব না। আমরা তো আপনাদের হাতে দিতে চাই, যাতে আপনারা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমাদের গতকাল বলা হলো, তারা আসবেন না। ঠিক আছে, আজকে আমরা গেলাম। আজকে গণস্বাস্থ্যের ড. বিজন কুমার শীলসহ তিনজন গেলেন। তারপরও দেখেন, কেমন আমলাতান্ত্রিকতা। দুজনকে ঢুকতে দেবে, আরেকজনকে দেবে না। অথচ বাইরের তিনজন লোককে ভেতরে বসিয়ে রেখেছেন। তাদের ব্যবসা সংশ্লিষ্ট লোকদের ভেতরে বসিয়ে রেখেছেন। ফিরোজ, তিনি হেড অব এ ডিপার্টমেন্ট অব নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পদমর্যাদায় ওই ডিজি সাহেবের সমতুল্য তিনি। এ জাতীয় লোককে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি যুক্তিতর্কে হেরে যাওয়ার ভয়ে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, গতকাল আমরা এখানে কিট হস্তান্তরের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম, এটার অনুমোদনের জন্য। এটা অনুমোদন করার দায়িত্ব হলো ওষুধ প্রশাসনের। দুর্ভাগ্যবশত, ওষুধ প্র্রশাসন এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তারা না ফার্মাসিস্ট, না ফার্মাকোলজিস্ট। তার ফলে এই জিনিসগুলির গুরুত্ব সেভাবে তারা উপলব্ধি করতেই সক্ষম হচ্ছেন না। তারা সম্পূর্ণ ব্যবসায়ী স্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন।
‘বিজ্ঞানীরা জনস্বার্থে এটি আবিষ্কার করেছেন। এটি ব্যবহারে যত দেরি হবে তত জনগণের ক্ষতি বেশি হবে। এ গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের গুরুত্ব আমরা ওষুধ প্রশাসনকে বোঝাতে পারছি না। সিআরও নামের এজেন্টকে পরীক্ষার জন্য ১০ লাখ টাকা দিতে হবে। আমরা চাই এটির মূল্য ২৫০ থেকে ২০০ টাকা নামাতে, আর তারা ব্যবসায়িক স্বার্থে নানা অজুহাতে ৫০০ টাকা দাম করতে চায়। ওষুধ প্রশাসন থেকে বলা হয়, দাম বাড়লে বাড়বে। এটা কি জনস্বার্থে কথা হলো? আমার ধারণা একটা শ্রেণী সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে।’
আপনারা গতকাল কিট হস্তান্তর করা হবে বলেছিলেন কেন? এ প্রশ্নের জবাবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, কিটটি পরীক্ষা করে দেখার জন্য সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে চেয়েছি। এখন আমার কাছে কিট থাকলেও সরকারের অনুমোদন ছাড়া আমরা পরীক্ষা করতে পারবো না।
তিনি বলেন, গত ১২ এপ্রিল কিটের যথার্থতা প্রমাণের জন্য সরকারের কাছে রক্ত চেয়েছি। কিন্তু পেয়েছি ২২ এপ্রিল, তাও আবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপের পর। আমার মতো লোক ২৫ বার ফোন করেছি।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালকের উদ্দেশে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, আপনাদের সকল ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করে দেবো, তবে ঘুষ দেবো না। গণস্বাস্থ্যের ৪৮ বছরে কাউকে ঘুষ দেইনি, এতে প্রোডাক্ট বাজারে আসুক না আসুক, আমরা ঘুষ দেইনি, দেবো না। এই দুর্নীতির অংশীদার হইনি, হবো না। আমরা আন্দোলন করে যাবো।
মহামারি করোনাভাইরাসে গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৪১৮ জন। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ৫ হাজার ৪১৬ জনে। সেইসঙ্গে করোনায় আরো ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৫ জনে।
রবিবার (২৬ এপ্রিল) দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে এ তথ্য জানানো হয়। অনলাইনে বুলেটিন উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ৪২২ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৭৬ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। ৪১৮ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে।
ডা. নাসিমা বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন ৫ জন। সুস্থ হয়েছে ৯ জন।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হন ৮ মার্চ এবং এ রোগে আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মত তিনজনের মধ্যে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের তথ্য জানায় আইইডিসিআর।
এরপর ২৫ মার্চ প্রথমবারের মতো রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানায়, বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিকভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হচ্ছে।