স্বাস্থ্যবিভাগের অনুমোদন ছাড়াই কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ও ফিজিওথেরাপি সেন্টার এবং ডেন্টাল কেয়ার। বৈধভাবে যেসব হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলছে, তাতেও স্বাস্থ্যবিভাগের নিয়মনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে না, রয়েছে প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব। সেবা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে অনভিজ্ঞ লোক দিয়ে।
স্বাস্থ্যবিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন বছরে দুই থেকে তিনবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে। তবে পরবর্তিতে মনিটরিং না থাকায় দিব্যি চলতে থাকে অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্য। এদের হাতে একপ্রকার জিম্মি হয়ে রোগীরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত ও সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।
সূত্র জানায়, হাতে গোনা কয়েকটির সরকারি অনুমোদন (লাইসেন্স) থাকলেও অধিকাংশ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া চলছে।
জানা যায়, চলতি বছরের মে মাসে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু তা বাস্তবায়নের তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। চার-পাঁচটি অভিযান চললেও প্রায় অর্ধশত অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক, ফিজিওথেরাপি সেন্টার ও ডেন্টাল কেয়ারে কোনো অভিযান হয়নি। যারা বৈধভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন, তারা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
উপজেলায় প্রায় ৯০টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক, ফিজিওথেরাপি সেন্টার ও ডেন্টাল কেয়ার রয়েছে। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তালিকায় আছে ৬৭টি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তালিকা অনুযায়ী ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স আছে। এর মধ্যে হালনাগাদকৃত লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ২১। কোনো কাগজপত্র নেই ১৯টি প্রতিষ্ঠানের। এছাড়া, তালিকার বাইরে ২৩টি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে কোনো তথ্য নেই।
দুবারের অভিযানে দাউদকান্দিতে আটটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। ইতোমধ্যে এর কয়েকটি আবারো সক্রিয় হয়েছে। এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তৌহিদ আল হাসান বলেন, ‘কাগজপত্র না থাকায় আমরা (প্রতিষ্ঠানগুলো) বন্ধ করে দিয়ে এসেছি, এখন চলছে কিনা জানি না।’
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ফার্মেসিতে অবৈধভাবে হাতুড়ে ডাক্তাদের অপচিকিৎসায় প্রতারিত হচ্ছেন দরিদ্র রোগীরা। উপজেলার গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাজার পর্যন্ত এক কিলোমিটার সড়কের উভয় পাশে প্রায় অর্ধশতাধিক হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। দাউদকান্দি বাজার, গৌরীপুর বাজার, গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণ বাজার, মলয় বাজার, ইলিয়টগঞ্জ বাজার, গোয়ালমারী বাজারসহ পুরো উপজেলায় এ রকম অজস্র প্রতিষ্ঠান দেখা যায়।
ভুল চিকিৎসা ও অনিয়মের অভিযোগ সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অভিজ্ঞ সার্জারি, গাইনি, অ্যানেসথেসিস্ট ডাক্তার না থাকায় ভুল চিকিৎসার কারণে প্রায়ই মা ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ রয়েছে, গৌরীপুর লাইফ হসপিটাল অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খাদিজা আক্তার নামে এক প্রসূতির জমজ শিশু হলেও একটি সন্তান পেটে রেখেই সেলাই করে দেন হাসপাতালের ডাক্তার। এ ঘটনাটি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। আবার প্রসূতি ভর্তি হয়ে আট ঘণ্টা চিকিৎসা না পেয়ে মৃত সন্তান প্রসবের অভিযোগ রয়েছে দাউদকান্দি পৌরসদরের এলহাম হাসপাতালের নামে। গৌরীপুর খিদমা হসপিটালে ভুল চিকিৎসায় মা ও নবজাতকের, রংধনু হসপিটালে প্রসূতির এবং দাউদকান্দি পৌরসদরের এলহাম ও ফ্যামিলি হাসপাতালে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা স্বাস্থ্যবিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ‘বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদন নেওয়ার সময় কাগজে-কলমে ডাক্তার, ডিপ্লোমাধারী প্যাথলজিস্ট দেখায়। অনুমোদন পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালালে আবেদনের সময় দেওয়া তথ্যের সাথে মিল পাওয়া যায় না।’
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ১০ শয্যার অনুমোদন নিয়ে রাখা হয় ১৫ শয্যা। হাতুড়ে নার্সদের দিয়ে রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। রোগ নির্ণয়ের জন্য মানসম্মত যন্ত্রপাতি বা ল্যাব টেকনোলজিস্ট নেই। সার্বক্ষণিক এমবিবিএস ডাক্তারের বদলে থাকেন ম্যানেজার ও মালিক। পার্টটাইম ডাক্তাররা জটিল অস্ত্রোপচারসহ অন্যান্য চিকিৎসা করছেন।
দাউদকান্দি নাগরিক ফোরামের আহ্বায়ক পরিবেশবিদ মতিন সৈকত বলেন, ‘অর্থলোভীরা এসব ক্লিনিকে অপচিকিৎসা দিয়ে থাকেন। ক্লিনিকগুলোতে স্থায়ী চিকিৎসক ও নার্স নেই। নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন এসব ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অপারেশন থিয়েটার থাকলেও তা মানসম্মত নয়। রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা নেই জেনেও টাকার লোভে ভর্তি করা হয়।’
বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. পারভেজ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘যাদের বৈধ কাগজপত্র আছে তাদেরকেই সমিতির সদস্য করা হয়েছে। এখানে সর্বাধিক ২৫/৩০টির মতো বৈধ (প্রতিষ্ঠান), বাকিগুলো কীভাবে চলে জানি না। দাউদকান্দির মতো গা-ছাড়া মনোভাব কোথাও দেখিনি। প্রতি বছরই এখানে কোনো কোনো হাসপাতালে দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আমরা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হই।’
দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডাঃ তৌহিদ আল হাসান বলেন, ‘দাউদকান্দিতে অনেক অবৈধ হাসপাতাল রয়েছে। সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর খবর আসে, তারা আবার চালু হয়েছে।’ এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
এ পর্যন্ত চলা অভিযানে দাউদকান্দিতে আটটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং ছয়টিকে জরিমানা করা হয়েছে।
জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মীর মোবারক হোসেন বলেন, ‘আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। প্রথমে যাদের লাইসেন্স নেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
ওমর ফারুক মিয়াজী, দাউদকান্দি (কুমিল্লা)