ফিচার
দাঁত ব্যথা : নিদারুণ এক যন্ত্রণার ইতিহাস
Published
2 years agoon
মধ্যযুগের একটা শহরের বাজারে, জাঁকালো পোশাক-পরা একজন হাঁতুড়ে ডাক্তার দম্ভের সঙ্গে বলছেন যে, তিনি কোনোরকম ব্যথা না দিয়েই দাঁত তুলতে পারেন। তার সহকারী, কিছুটা গড়িমসি ভাব করেন, সামনে এগিয়ে যান আর সেই হাতুড়ে ডাক্তার তার সহকারীর একটা দাঁত তোলার ভান করেন, একটা রক্তাক্ত দাঁত ওপরে তুলে সবাইকে দেখান। এরপর, দাঁত ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে এমন ব্যক্তিরা সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দাঁত তুলতে উৎসাহিত হয়। প্রচণ্ড জোরে ড্রাম ও তুরী বাজানো হয়, যাতে তাদের ব্যথার চিৎকার শুনে অন্যেরা দাঁত তোলা থেকে বিরত না হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই, সেই জায়গায় কখনো কখনো মারাত্মক পচন ধরে কিন্তু ততদিনে সেই হাঁতুড়ে ডাক্তার উধাও হয়ে গিয়েছেন।
আজকে দাঁত ব্যথায় ভুগছে এমন অল্প লোকেরই এই ধরনের ভণ্ড ব্যক্তিদের কাছে দাঁত তোলার জন্য যেতে হয়। আধুনিক দন্তচিকিৎসকরা ব্যথা উপশম করতে পারে এবং তারা প্রায়ই দাঁত পড়ে যাওয়াকে রোধ করতে পারে। তা সত্ত্বেও, অনেক লোক একজন দন্তচিকিৎসকের কাছে যেতে ভয় পায়। দন্তচিকিৎসকরা তাদের রোগীদের ব্যথা উপশম করার বিষয়টা প্রথমে কীভাবে শিখেছিল, তা বিবেচনা করা আমাদের হয়তো আধুনিক দন্তচিকিৎসার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে সাহায্য করবে।
সাধারণ সর্দিকাশির পর দন্তক্ষয়ই হচ্ছে মানবজাতির দ্বিতীয় সাধারণ রোগ। এটা শুধুমাত্র আধুনিক সময়ের কোনো রোগ নয়। রাজা শলোমনের কাব্য প্রকাশ করে যে, “প্রাচীন ইস্রায়েলে বয়স্ক লোকেদের অল্প কয়েকটা দাঁত থাকার অস্বস্তি এক সাধারণ বিষয় ছিল।” – উপদেশক ১২:৩.
এমনকি রাজবংশীয় লোকেরাও ভুগেছিল এই দাঁত ব্যথা নামক যন্ত্রণায়। এলিজাবেথ ১ম, যদিও ইংল্যান্ডের রানি ছিলেন কিন্তু তিনি পর্যন্ত দাঁত ব্যথা থেকে রেহাই পাননি। রানির কালো দাঁত দেখে একজন জার্মান পর্যটক রিপোর্ট করেছিলেন যে, ‘প্রচুর পরিমাণে চিনি খাওয়ার কারণে’ এটা ‘ইংরেজদের একটা সাধারণ খুঁত বলে মনে হয়।’ ১৫৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, দাঁত ব্যথার কারণে রানি রাতদিন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ভুগেছিলেন। তার চিকিৎসকরা তাকে রোগাক্রান্ত দাঁত তুলে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিল কিন্তু তিনি তাতে সম্মত হননি, সম্ভবত ব্যথার কথা ভেবে তিনি ভয় পেয়েছিলেন। তাকে দাঁত তুলতে রাজি করানোর জন্য লন্ডনের বিশপ জন এলমার, রানির সামনে সম্ভবত তার নিজের একটা ক্ষয়প্রাপ্ত দাঁত তুলে ফেলার ব্যবস্থা করেছিলেন—এক দুঃসাহসিক ও আত্মত্যাগমূলক কাজ, কারণ এই বয়স্ক ব্যক্তির মাত্র অল্প কয়েকটা দাঁতই অবশিষ্ট ছিল!
সেই সময়ে, যেসব সাধারণ লোকের দাঁত তোলার প্রয়োজন হতো, তারা এর জন্য একজন ক্ষৌরকার অথবা এমনকি একজন কামারের কাছে যেত। কিন্তু যখন বেশির ভাগ লোকের চিনি কেনার সামর্থ্য হয়েছিল, তখন থেকে দাঁত ব্যথা বৃদ্ধি পেয়েছিল আর সেইসঙ্গে দাঁত তোলায় দক্ষ ব্যক্তিদের চাহিদাও বেড়ে গিয়েছিল। এই কারণেই, কিছু চিকিৎসক এবং সার্জন রোগাক্রান্ত দাঁতের চিকিৎসা করার প্রতি আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছিল। কিন্তু, এই বিষয়টা তাদের নিজে নিজে শিখতে হয়েছিল কারণ বিশেষজ্ঞরা ঈর্ষাবশত তাদের ব্যবসায়িক কলাকৌশলকে গোপন রাখত। এ ছাড়া, এই বিষয়ের ওপর বইপত্রের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না।
এলিজাবেথ ১ম এর সময়কালের একশো বছর পর, চতুর্দশ লুই ফ্রান্সে রাজা হিসেবে শাসন করেছিলেন। তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় দাঁত ব্যথায় ভুগেছিলেন এবং ১৬৮৫ সালে তিনি তার ওপরের পাটির বাম দিকের সব দাঁত তুলে ফেলেছিলেন। কেউ কেউ দাবি করে যে, রাজার দাঁতের সংক্রমণই সেই বছর তার দ্বারা নেওয়া এক ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্তের কারণ, যার ফলে তিনি ফ্রান্সে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করার এক চুক্তিতে সই করেছিলেন, যে-পদক্ষেপটা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এক তীব্র তাড়নার ঢেউ বইয়ে দিয়েছিল।
আধুনিক দন্তচিকিৎসার উৎপত্তি নিয়ে আগ্রহ থেকে ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে দেখা যায় প্যারিসের শৌখিন সমাজে, চতুর্দশ লুইয়ের ব্যয়বহুল জীবনধারার প্রভাব দন্তচিকিৎসা পেশার উৎপত্তি ঘটিয়েছিল। বিচারালয় এবং সমাজে সফল হওয়াটা একজনের বাহ্যিক সৌন্দর্যের ওপর নির্ভর করত। খাবার খাওয়ার চাইতে চেহারার সৌন্দর্য রক্ষায় নকল দাঁত বেশি ব্যবহৃত হওয়ায় এর চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল আর এর ফলে সার্জনদের দাঁত ব্যথার শিকার অভিজাত শ্রেণীর লোকেদের জন্য কর্মরত দন্তচিকিৎসকদের এক নতুন দলের উদ্ভব হয়েছিল। প্যারিসের প্রধান দন্তচিকিৎসক ছিলেন পিয়ার ফশার। যিনি ফ্রেঞ্চ নৌবাহিনীতে থাকার সময় অপারেশন করতে শিখেছিলেন। তিনি সেই সার্জনদের সমালোচনা করেছিলেন, যারা দাঁত তোলার কাজটা অদক্ষ ক্ষৌরকার ও হাঁতুড়ে ডাক্তারদের ওপর ছেড়ে দিয়েছিল আর তিনিই প্রথম নিজেকে একজন ডেন্টাল সার্জন হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
ব্যাবসায়িক কলাকৌশল গোপন করে রাখার ধারা ভঙ্গ করে, ফশার ১৭২৮ সালে একটি বই লিখেছিলেন, যেখানে তিনি তার জানা সমস্ত পদ্ধতি প্রকাশ করেছিলেন। ফলে, তিনিই “দন্তচিকিৎসাবিদ্যার জনক” বলে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি রোগীদেরকে মেঝেতে বসানোর পরিবর্তে বিশেষ এক ধরনের চেয়ারে বসিয়েছিলেন। এ ছাড়া, ফশার দাঁত তোলার জন্য পাঁচটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন, তবে তিনি শুধুমাত্র দাঁতই তুলতেন না। তিনি দাঁতের চিকিৎসার জন্য এক ধরনের ছোট্ট ড্রিল মেশিনের এবং দাঁতের মধ্যে সৃষ্ট গর্ত ভরাট করার বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। তিনি রুট ক্যানেল করা এবং দন্তমূলে এক কৃত্রিম দাঁত বসাতেও শিখেছিলেন। তার ডেন্চার (কৃত্রিম দাঁতের পংক্তি) যেটা হাতির দাঁত থেকে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছিল, সেটাতে একটা স্প্রিং লাগানো ছিল, যাতে ডেন্চারের ওপরের অংশটুকু জায়গামতো বসানো যায়। ফশার দন্তচিকিৎসাকে একটা পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার খ্যাতি এমনকি আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে আমেরিকাতেও প্রসারিত হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতির মত ব্যাক্তিও রেহাই পায় নি দাঁত ব্যথা নামক নরক যন্ত্রণা থেকে। চতুর্দশ লুইয়ের শাসনের একশো বছর পর, আমেরিকাতে জর্জ ওয়াশিংটন দাঁত ব্যথায় ভুগেছিলেন। ২২ বছর বয়স থেকে প্রায় প্রতি বছরই তাকে তার দাঁত তুলতে হয়েছিল। কন্টিনেন্টাল আর্মি-কে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় তিনি যে-যন্ত্রণায় ভুগেছিলেন, তা একটু কল্পনা করুন! ১৭৮৯ সালে তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, সেই সময়ের মধ্যে তার প্রায় সব দাঁতই পড়ে গিয়েছিল।
দাঁত পড়ে যাওয়ার কারণে চেহারা বিকৃত হয়ে যাওয়ায় ও সেইসঙ্গে তার মুখে বসানো নড়বড়ে ডেন্চারের কারণে জর্জ ওয়াশিংটন মানসিক যন্ত্রণায়ও ভুগেছিলেন। তিনি এক নতুন দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য জনগণের সামনে এক উত্তম ভাবমূর্তি তুলে ধরার সংগ্রাম করার সময় তার চেহারা সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। সেই সময়ে ডেন্চারগুলোকে ছাঁচে ঢেলে আকার দেওয়া হতো না কিন্তু হাতির দাঁত থেকে খোদাই করে তৈরি করা হতো আর তাই সেগুলো যথাস্থানে বসানো খুব মুশকিল ছিল। ইংরেজ লোকেরাও ওয়াশিংটনের মতো একই অসুবিধাগুলো ভোগ করেছিল। কথিত আছে যে, হাস্য-রসাত্মক কথাবার্তার সময় তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসার পরিবর্তে মুচকি হাসি হাসতো, যাতে তাদের নকল দাঁত লুকাতে পারে।
এমন কথা প্রচলিত আছে যে, ওয়াশিংটন কাঠের তৈরি ডেন্চার ব্যবহার করতেন কিন্তু এটা স্পষ্টতই মিথ্যা। তার ডেন্চার মানুষের দাঁত, হাতির দাঁত এবং সীসা দিয়ে তৈরি ছিল কিন্তু কাঠ দিয়ে নয়। তার দন্তচিকিৎসকরা সম্ভবত কবর লুটকারীদের কাছ থেকে দাঁত সংগ্রহ করেছিল। এ ছাড়া, দাঁত ব্যবসায়ীরা সৈন্যদের পিছনে পিছনে যেত এবং যুদ্ধের পর নিহত বা মারা যাচ্ছে এমন সৈন্যের দাঁত তুলে নিত। তাই, ডেন্চার বসানো ধনী ব্যক্তিদের বিলাসিতার এক বিষয় ছিল। ১৮৫০ দশকে ভালকানাইজড রবার আবিষ্কৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ডেন্চারের ভিত হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে এবং তখন থেকে ডেন্চার সাধারণ লোকেদের কাছে প্রাপ্তিসাধ্য হয়ে উঠে। জর্জ ওয়াশিংটনের দন্তচিকিৎসকরা এই পেশায় অগ্রদূত হওয়া সত্ত্বেও, তারা দাঁত ব্যথার কারণ পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি।
প্রাচীনকাল থেকেই লোকেরা মনে করত যে, এক ধরনের পোকা দাঁত ব্যথার কারণ—যে-ধারণাটা ১৭০০ শতাব্দী পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। ১৮৯০ সালে, উইলোবি মিলার নামে আমেরিকার একজন দন্তচিকিৎসক, জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় দন্তক্ষয়ের কারণ শনাক্ত করেছিলেন, যা দাঁত ব্যথার একটা প্রধান কারণ। বিশেষভাবে চিনির মধ্যে বৃদ্ধি পায় এমন এক নির্দিষ্ট ধরনের ব্যাকটিরিয়া অম্ল উৎপন্ন করে, যা দাঁতকে আক্রান্ত করে। কিন্তু, দন্তক্ষয়কে কীভাবে রোধ করা যেতে পারে? এর উত্তরটা আসলে অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া গিয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে বেশ অনেক বছর ধরে দন্তচিকিৎসকরা মনে মনে চিন্তা করছিল যে, সেখানকার অনেক লোকের কেন দাগযুক্ত দাঁত রয়েছে। অবশেষে জানা যায় যে, জলে মাত্রাতিরিক্ত ফ্লোরাইড থাকার কারণে এমনটা হয়েছে। কিন্তু, স্থানীয় এই সমস্যার বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সময় গবেষকরা অপ্রত্যাশিতভাবে এক আবিষ্কার করেছিল, দাঁত ব্যথা প্রতিরোধের জন্য পৃথিবীব্যাপী যে-বিষয়টার গুরুত্ব ছিল: যেসব জায়গার খাবার জলে অপর্যাপ্ত মাত্রায় ফ্লোরাইড রয়েছে, সেখানে যে-লোকেরা বড় হয়ে উঠেছে, তাদের দন্তক্ষয় বেশি হয়েছে। ফ্লোরাইড হচ্ছে দাঁতের ইনামেলের (দাঁতের শক্ত বহিরাবরণ) একটা উপাদান, যা অনেক জায়গার জল সরবরাহে প্রকৃতিগতভাবেই থাকে। যে-লোকেদের জল সরবরাহে ফ্লোরাইডের ঘাটতি রয়েছে, সেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণে ফ্লোরাইড সরবরাহ করা হলে, দাঁতের ক্ষয়ের প্রকোপ অন্তত ৬৫ শতাংশ কমে যায়।
এভাবে সেই রহস্যের সমাধান হয়েছিল। দন্তক্ষয়ের কারণেই অধিকাংশ দাঁত ব্যথা হয়। চিনি দন্তক্ষয়ের কারণ। ফ্লোরাইড এর প্রতিরোধে সাহায্য করে। অবশ্য, এটা ভালভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, ফ্লোরাইড কখনোই পর্যাপ্ত ব্রাশ ও ফ্লস করার বিকল্প হতে পারে না।
চেতনানাশক পদার্থ আবিষ্কারের আগে, দন্তচিকিৎসার প্রক্রিয়া রোগীদের জন্য নিদারুণ যন্ত্রণা সৃষ্টি করত দন্তচিকিৎসকরা ধারালো যন্ত্রপাতি দিয়ে দূর্বল, ক্ষয়প্রাপ্ত দাঁত তুলে ফেলত আর এরপর গর্তটা ভরাট করার জন্য সেখানে উত্তপ্ত গলিত ধাতু ঢেলে দেওয়া হতো। যেহেতু তাদের কাছে অন্য ধরনের কোনো চিকিৎসা ছিল না, তাই তারা যে-দাঁতের আভ্যন্তরীণ তন্তু (পাল্প) সংক্রামিত হয়েছিল, সেখানকার কোষগুলোকে নষ্ট করার জন্য রুট ক্যানেলের মধ্যে একটা জ্বলন্ত গরম লোহার শলাকা ঢুকিয়ে দিত। বিশেষ যন্ত্রপাতি ও চেতনানাশক পদার্থ আবিষ্কারের আগে দাঁত টেনে তোলাও এক চরম অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা ছিল। দাঁত ব্যথা অত্যন্ত কষ্টদায়ক বলে লোকেরা এই ধরনের এক অত্যাচারকে মুখ বুজে সহ্য করত। যদিও বিভিন্ন ভেষজ উপাদান যেমন আফিম, ভাং এবং নিদ্রা উদ্রেককারী গাছের নির্যাস শত শত বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে কিন্তু এগুলো কোনোভাবেই ব্যথার তীব্রতা কমাতে পারেনি। তা হলে, দন্তচিকিৎসকরা কি কখনো ব্যথাহীন অপারেশন করতে সক্ষম হবে?
ইংরেজ রসায়নবিদ জোসেফ প্রিস্টলি যখন ১৭৭২ সালে প্রথম নাইট্রাস অক্সাইড বা লাফিং গ্যাস প্রস্তুত করেন। তার কিছু পরেই এটার চেতনানাশক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। কিন্তু, ১৮৪৪ সালের আগে পর্যন্ত কেউই এটাকে এক চেতনানাশক পদার্থ হিসেবে ব্যবহার করেনি। সেই বছরের ১০ই ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটের হার্টফোর্ডে হরেস ওয়েলস নামে একজন দন্তচিকিৎসক এমন একটা বক্তৃতায় যোগ দিয়েছিলেন, যেখানে লোকেদের লাফিং গ্যাসের সাহায্যে আনন্দদান করা হয়েছিল। ওয়েলস লক্ষ করেছিলেন যে, এই গ্যাসের প্রভাবে একজন ব্যক্তি একটা ভারী বেঞ্চে তার পা ঘষেও ব্যথার কোনো লক্ষণ প্রকাশ করেননি। ওয়েলস একজন সহানুভূতিশীল ব্যক্তি ছিলেন আর দাঁতের চিকিৎসার সময় তার রোগীদের তিনি যে-ব্যথা দিতেন, সেই কারণে নিজে বেশ অস্বস্তি বোধ করতেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এই গ্যাসকে চেতনানাশক পদার্থ হিসেবে ব্যবহার করার বিষয় চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু, এটা অন্যের ওপর প্রয়োগ করার আগে, তিনি নিজের ওপর প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ঠিক পরদিনই তিনি তার নিজের সেই বিশেষ চেয়ারে বসেন এবং অচেতন না হওয়া পর্যন্ত তার শ্বাসের সঙ্গে সেই গ্যাস গ্রহণ করেছিলেন। এরপর একজন সহকর্মী তার আক্কেল দাঁত তুলে ফেলেছিলেন। এটা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। অবশেষে, ব্যথাহীন দন্তচিকিৎসা সম্ভব হয়েছিল!
সেই সময়ের পর থেকে দন্তচিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত অনেক উন্নতি ঘটেছে। তাই, আপনি দেখতে পাবেন যে, আজকে দন্তচিকিৎসকের কাছে যাওয়া বেশ আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতাই হবে।
ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি দারুণ সিরিয়াস নাসরিন সুলতানা ইভা। পড়তে চেয়েছিলেন ইংলিশ ভার্সনের স্কুল-কলেজে, কিন্তু নিজ জেলা শহরে এর সুবিধা না থাকায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই ভর্তি হন বাংলা ভার্সনে। ইভা লেখাপড়া করেছেন মুন্সিগঞ্জের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ-এ। সেখান থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। এরপর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাতেও ছিলেন সপ্রতিভ।
২০২২ সালের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় সারাদেশের মধ্যে ৫০ তম স্থান অধিকার করেন। তবে সবচেয়ে বড় চমক দেখিয়েছেন তিনি ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায়। যেখানে অংশ নিয়েছিল প্রায় ৬৬ হাজার শিক্ষার্থী। ইভা সেই পরীক্ষাতে ভালো তো করলেনই, সাথে প্রথম হওয়ার গৌরব দেখালেন।
ইভা তখন অষ্টম কি নবম শ্রেণিতে পড়েন। মেডিকেলে উত্তীর্ণ আপুদের উৎফুল্লতা, তাদের ঘিরে অন্যদের উৎসব-উন্মাদনা চোখের সামনে দেখতেন। সেই থেকে এ বিষয়গুলোর প্রতি ভালো লাগার শুরু তার। পড়ালেখার সময়ে কঠোর অধ্যবসায়, আর অবসরে কল্পনার রঙিন জগতে মেডিকেলের শিক্ষার্থী হিসেবে ঘুরে বেড়ানো ইভার জন্য তখন থেকে নিত্যদিনের ঘটনা। এভাবেই ভালো লাগা থেকে ভালো করার আকাঙ্ক্ষা; তৈরি হতে থাকে স্বপ্ন পূরণের এক মহা বন্দোবস্ত।
সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, তাহলে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা কীভাবে হবে! এ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। আবার, কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় গত ফেব্রুয়ারিতে বন্ধ হয়ে যায় দেশের সব স্কুল, কলেজ, কোচিং সেন্টার। তখন অনলাইনে নতুন শিক্ষা পদ্ধতির সাথে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লেগেছিল ইভার। তবে সব প্রতিবন্ধকতার মাঝেও তিনি ছিলেন শৃঙ্গের মতো দৃঢ়। এক মুহূর্তের জন্যও আত্মবিশ্বাস হারাননি, নিজের সাথে আপোষ করেননি কোনো বিষয়ে। ফলস্বরূপ, সাফল্যের হাসি।
৫ এপ্রিল প্রকাশিত হয় ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল। যেহেতু ভর্তি পরীক্ষা আশানুরূপ হয়েছিল, ভালো কোনো মেডিকেলেই যে সুযোগ পাচ্ছেন, তা আগে থেকে অনুমেয় ছিল। তাই বলে ৫০তম! এটি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি ছিল, জানালেন ইভা। এর ২২ দিন পর ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা। এদিকে এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই ইভার। কারণ, ততদিনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। শেষমেশ মায়ের পীড়াপীড়িতে পরীক্ষা দিলেন, কোনো ধরনের প্রস্তুতি না নিয়েই। অথচ এ পরীক্ষাতে ইভা ছাড়িয়ে গেছেন আগের ইভাকেও। মেধার দ্যুতি ছড়িয়ে তিনি সারাদেশের মধ্যে অর্জন করেন প্রথম স্থান।
ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির সুবিধার্থে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন ইভা, সঙ্গে তার বড়বোন। এ সময়টাতে মা-বাবার অভাব ঘুচানোর সব রকমের চেষ্টা করেছেন বড় বোন আইরিন সুলতানা। একইসাথে মা-বাবা, শিক্ষকদের সমর্থন ছায়ার মতো ছিল ইভার জীবনে। তাই এই সাফল্যের পেছনে তাদের অবদানের কথা ইভা স্মরণ করেন আত্মতৃপ্তির সঙ্গে। মেডিকেলে ৫০ তম এবং ডেন্টালে প্রথম হওয়ার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ইত্তেফাককে তিনি বলেন, খুবই ভালো লাগছে। এত এত শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের মধ্যে এত ভালো একটা রেজাল্ট করতে পেরেছি, তার জন্য আমি আনন্দিত। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। বাবা-মা, শিক্ষকেরা যারা সবসময় আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন, তাদের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ।
ইভার জন্ম মেহেরপুরের পিরোজপুরে। বাবা মো. ইউনুস আলী সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গণিতের প্রভাষক, মা গৃহিনী। বাবার চাকরিসূত্রে ইভার শৈশব ও কৈশোর দুই-ই কেটেছে মুন্সিগঞ্জে। দুই বোনের মধ্যে ছোট ইভার পছন্দের কাজ ছবি আঁকা, বই পড়া, ভ্রমণ করা আর সেসবের ভিডিও ক্লিপস নিজের ইউটিউব চ্যানেলে (ইভা’স জোন) আপলোড করা।।
অর্জন
চিকিৎসক পদক ২০২১ পেলেন অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মোল্লা
Published
8 months agoon
December 14, 2021গত ৭ ই এপ্রিল ২০২১ এ বাংলাদেশ মেডিকেল টিচার্স ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ও প্লাটফর্ম অব মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল সোসাইটি চিকিৎসক, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য পেশাজীবী বিভাগে চিকিৎসক পদক ২০২১ এর তালিকা প্রকাশ করে। উক্ত তালিকায় ডেন্টিস্ট্রি এন্ড এলায়েড বিষয়ে অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মোল্লা নির্বাচিত হন।
গতকাল (১৩/১২/২১) রাজধানীর কুর্মিটোলায় অবস্থিত হোটেল লা মেরিডিয়ানে পদক প্রদান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
পদক গ্রহণপূর্বক বক্তৃতায় অধ্যাপক ডা.মতিউর রহমান মোল্লা বলেন – “মেডিকেল ও ডেন্টাল এর এত গুণীজনদের মাঝে আমাকে নির্বাচিত করায় আমি আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ডেন্টিস্ট্রিতে এই প্রথম আমি নির্বাচিত হয়েছি বলে উচ্ছসিত। আশির দশকে দেশে এসে দেখি ডেন্টিস্ট্রির করুনদশা।
১৯৮৭ সালে দেশে আশার পরে আমার কয়েকজন সাথিকে নিয়ে আমি উদ্যোগ নেই যে দেশে ওরাল এন্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারী প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং ঢাকা ডেন্টাল কলেজে আমরা প্রথম ট্রেইনিং প্রোগ্রাম শুরু করি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকা ডেন্টাল কলেজে এম এস কোর্স চালু করি।
পরবর্তীতে ২০০০ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীতে ২০ বেডের ওরাল এন্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারী ইউনিট আমার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং এম এস কোর্স রিকগনাইজড করানো হয়।
এছাড়াও ২০০৪ সালে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এও ওরাল এন্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারীর ডীন ও চেয়ারম্যান ছিলাম। সেখানে ২০ বেডের ওয়ার্ডসহ ইউনিটটিকে পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেইনিদের জন্যে সুন্দরভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছি।
আমার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমার ছেলে-মেয়েকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা যাতে তারা দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারে।”
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ওরাল এন্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জানস এসোসিয়েশন(বামোস) এর অগ্রযাত্রা শুরু হয় অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মোল্লার মাধ্যমে। এ বিষয়ে তিনি ডেন্টাল টাইমসকে জানান – “ প্রথমদিকে আমার হাত ধরে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ থেকে বাামোস এর যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে ডা. এস এম ইকবাল শহিদ, ডা. রফিক আহমেদ ভূঁইয়া, ডা. কে এইচ আলতাফ এবং ডা. মহিউদ্দীন আহমেদ ওরাও যুক্ত হয়।”
অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মোল্লা বর্তমানে আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ এর অনারারী অধ্যাপক এবং সিনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে এভারকেয়ার হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন।
জীবন ও কর্ম
সমাজকল্যাণের অগ্রযাত্রায় ফিমেল ডেন্টাল সার্জন অব বাংলাদেশ
Published
8 months agoon
December 7, 2021৩ ডিসেম্বর অত্যন্ত জাকজমক ভাবে, প্লাটিনাম ক্লাব,ধানমন্ডিতে উদযাপিত হলো, ফিমেল ডেন্টাল সার্জনস অব বাংলাদেশ ক্লাবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় মন্ত্রী ডা.দীপু মনি,এম.পি,শিক্ষা মন্ত্রনালয়, বাংলাদেশ।
এই প্রথম সারা বাংলাদেশের সমগ্র ফিমেল ডেন্টাল সার্জনদের একত্রিত করার উদ্দ্যোগ নেন ক্লাবের প্রতিস্ঠাতা ডা. ফারিয়া তাবাসসুম তন্বী। এই ক্লাবের যাত্রা শুরু হয় ১৫ জুন,২০১৯ সালে ফেইসবুকের একটি গ্রুপের মাধ্যমে।
কভিড ১৯ অতিমারীতে সারা বাংলাদেশ ব্যাপী রাত দিন ২৪ ঘন্টা অনলাইন টেলিমেডিসিন, অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ, প্লাজমা সংগ্রহ, আই,সি,ইউ,বেড,এম্বুলেন্স সহযোগীতা করেছে এই এফ ডি এস বি ক্লাব।যা অসংখ্য মানুষের জীবন বাচাতে সাহায্য করেছে। এই গ্রুপের প্রতিস্ঠাতা ডা.ফারিয়া তাবাসসুম তন্বীকে মানবিক ডাক্তার বলে বিভিন্ন গণ মাধ্যমে আখ্যায়িত করা হয়।এর পাশাপাশি ঘরে রেখে অতিমারীর সময় রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করে হাস্পাতাল সন্কট মকাবেলায় দেশের মানুষের পাশে থাকার জন্য,তাকে আইডিয়া জেনেরেটর বলা হয়।এই ফেইসবুক গ্রুপের সকল সমাজ কল্যান মুলক কার্যক্রমকে পরবর্তীতে অব্যাহত রাখার জন্য ২১ জন ফিমেল ডেন্টাল সার্জনকে নিয়ে গঠন করা হয় ফিমেল ডেন্টাল সার্জন অব বাংলাদেশ ক্লাব(এফ ডি এস বি).
ফিমেল ডেন্টিস্ট সকলকে এক সাথে নিয়ে চলা,প্রফেশনে পিছিয়ে পড়া ডেন্টিস্টদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি জাতীয় সমস্যায় দেশের মানুষের পাশে দাড়ানো জন্য সমাজ কল্যাণ মুলক কাজে উদ্ভুদ্ধ করার জন্য, যে সকল উদ্দ্যোগ এই ক্লাব থেকে নেয়া হয়েছে তার প্রশংসা করেন মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী ড. দীপু মনি।তিনি তাদের ভালো ডেন্টিস্ট হওয়ার পাশাপাশি খুব ভালো মানুষ এবং ভালো নাগরিক হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
পরিশেষে তার ভাষনে, ফিমেল ডেন্টাল সার্জনস অব বাংলাদেশ ক্লাবের উত্তরোত্তর উন্নয়ন কামনা করছেন।
ন্যানো অর্থ একশ কোটি ভাগের এক ভাগ। অতি ক্ষুদ্র এসব কণিকার কাজ করার বৈশিষ্ট্য বা গুণ বড় বড় কণা বা পদার্থদের থেকে অনেক আলাদা হয়। ন্যানো ডেন্টাল কণিকার আবিষ্কার দাঁতের চিকিত্সাবিজ্ঞানকে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়। ন্যানো পাউডার, ন্যানো কম্পোজিট এবং এ ধরনের আরও ন্যানো কণিকা, ন্যানো ফিলার ও অন্যান্য ন্যানো যন্ত্রের বিকাশ দন্ত চিকিত্সাকে উন্নত করছে দিন দিন।
দাঁতের চিকিত্সায় আজকাল সাদা কম্পোজিট ফিলিংয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে সিলিকা ও জিরকোনিয়ামের ন্যানো কণিকার মিশ্রণ। ন্যানো কম্পোজিট রেজিন বাড়িয়ে দিচ্ছে ফিলিংয়ের স্থায়িত্ব। দাঁতের স্বাভাবিক রঙের সঙ্গে এর রঙের মিল রয়েছে। তাই ফিলিংয়ের পরে দাঁত দেখতে আর কটু হচ্ছে না, সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন থাকছে প্রায় শতভাগ। আবার ক্রাউন বা ব্রিজ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ন্যানো আকৃতির ইট্রিয়াম, যা ক্রাউনের স্থাপনাকে করছে আরও মজবুত।
এসব ন্যানো কণিকার অনেকেরই থাকে সেলফ-হিলিং ক্যাপাসিটি। তাই এরা ক্ষয়প্রাপ্ত হলে নিজেরাই সেই ক্ষয় রোধ করতে সক্ষম। এরা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঠেকিয়ে দিতে পারে। ফলে দাঁত অনেক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।
ন্যানো কণিকা ব্যবহার করা হচ্ছে দাঁতের রোগ শনাক্ত করতেও। দাঁতের ক্ষয়রোগের প্রধান কারণ দাঁতের ওপর জীবাণুদের বিস্তার। দীর্ঘ সময় ধরে জীবাণুরা দাঁতের ওপর একধরনের বায়োফিল্ম বা পরত তৈরি করে। এসব জীবাণু ধ্বংস করতে হলে তাদের আগে চিহ্নিত করতে হয়। আর এই প্রক্রিয়া অনেক লম্বা।
ন্যানো ডেন্টিস্ট্রিতে এসব জীবাণু শনাক্ত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে কোয়ান্টাম-ডট ন্যানো কণিকা। এসব কোয়ান্টাম-ডট দাঁতের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে এলেই জ্বলে ওঠে। ফলে সহজেই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আলোতে শনাক্ত করা যায়। কোয়ান্টাম-ডট তার প্রতিপ্রভা ক্ষমতার মাধ্যমে মুখগহ্বরে কোনো ক্ষতিকর কোষ থাকলে আলো নিঃসরণ করতে পারে। মুখের ক্যানসার নির্ণয়েও খুবই কার্যকর হতে পারে এই প্রযুক্তি।
টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং ডেন্টিস্ট্রি বিজ্ঞানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। মুখের ফ্র্যাকচার, কার্টিলেজ বা লিগামেন্ট পুনর্গঠন, হাড়ের বৃদ্ধি ইত্যাদিতে টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভূমিকা অপরিসীম। এই প্রক্রিয়ায় বর্তমানে ব্যবহূত বিভিন্ন জৈব পলিমারের সঙ্গে ন্যানো উপাদান যুক্ত করে পুনর্গঠিত লিগামেন্ট বা হাড়কে আরও মজবুত ও স্থায়ী করা যেতে পারে। ইদানীং অনেক টুথপেস্টেও ব্যবহার করা হচ্ছে ন্যানো আকৃতির ক্যালসিয়াম কার্বনেট। ফলে রিমিনারালাইজেশন প্রক্রিয়ায় দাঁতের এনামেলের প্রাথমিক ক্ষত সারানো সম্ভব হয়েছে। কিছু কিছু পেস্টে যুক্ত করা হয়েছে সিলভারের ন্যানো কণিকা। এই কণিকাগুলো দাঁতের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া স্ট্রেপটোকক্কাস মিউট্যান্সের বিস্তার কমিয়ে দিতে পারে। ফলে ওই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে ক্ষত সৃষ্টির হার কমে যায়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ন্যানো ডেন্টিস্ট্রিই হবে ভবিষ্যতের মূল দন্ত চিকিত্সা। এই পদ্ধতিতে ন্যানো কণিকা ব্যবহারের পাশাপাশি ডেন্টাল হাইজেনিস্ট, অ্যাসিস্ট্যান্ট ও টেকনিশিয়ানদের ভূমিকা পালন করবে কার্বন ‘ন্যানো রোবট’। ভবিষ্যতের এই রোবটগুলো আকৃতিতে ১০০ ন্যানো মিটারের কাছাকাছি হবে। এরা কাজ করতে পারবে কোষ থেকে শক্তি নিয়ে। কম্পিউটারের সঙ্গে সিগন্যালের মাধ্যমে যুক্ত থাকবে এই রোবটগুলো। ফলে এদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে অনায়াসে।
ভবিষ্যতে দাঁতের চিকিত্সকেরা ডেন্টাল রোবটগুলো ব্যবহার করবেন দাঁত অবশ করতেও। কোলয়ডাল সাসপেনশনে থাকা মিলিয়ন মিলিয়ন ন্যানো রোবট মাড়ির পাশ দিয়ে প্রায় ১০০ সেকেন্ডের মধ্যে দাঁতে ঢুকতে পারবে। তারপর পাল্পে করে দাঁতের কম্পিউটারের নির্দেশ অনুযায়ী দাঁতের স্নায়ুগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সুতরাং দাঁতের চিকিত্সক ও রোগী উভয়ের জন্যই এ ধরনের ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার সুবিধাজনক হবে।
দাঁত শিরশির করার সমস্যা অর্থাৎ ডেন্টিন সেনসিটিভিটিতে কমবেশি সবাই ভোগেন। ডেন্টিন হলো দাঁতের দ্বিতীয় স্তর। ধারণা করা হয়, ডেন্টিন টিউবিউলগুলো নার্ভাস সিস্টেমকে সিগন্যাল পাঠিয়ে উদীপ্ত করে। ফলে দাঁতে শিরশির অনুভূতি হয়। সাধারণ চিকিত্সা পদ্ধতিতে এই অনুভূতি থেকে সাময়িক পরিত্রাণ পাওয়া যায়। কিন্তু স্থায়ী মুক্তি মেলে না। ন্যানোরোবট ব্যবহার করে শিরশিরে অনুভূতির জন্য দায়ী ডেন্টিন টিউবিউলগুলোকে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া যাবে।
অর্থোডেন্টিক ইউনিট আঁকাবাঁকা দাঁত সোজা করার বিষয়টি সমাধান করে। দাঁতের ব্রেইসের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। এই পদ্ধতিতে দাঁত সোজা করতে লেগে যায় বছরের পর বছর। দীর্ঘমেয়াদি এই চিকিত্সাপদ্ধতিকে বদলে দিতে পারে ভবিষ্যতের অর্থোডেন্টিক ন্যানো রোবট। এই রোবটগুলো সরাসরি দাঁতের চারপাশের টিস্যু, পেরিওডন্টাল লিগামেন্ট, সিমেন্ট, হাড় ইত্যাদির গঠন বদলে প্রয়োজনমতো দাঁতের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। এভাবে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় আঁকাবাঁকা দাঁত সোজা করে ফেলতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করছেন দন্ত বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, শিগগিরই ন্যানো টেকনোলজির কল্যাণে দাঁতের সমস্যা শনাক্তকরণ, দাঁত অবশকরণ থেকে শুরু করে দাঁতের সব ধরনের চিকিত্সায় ব্যবহৃত উপাদান এবং অস্ত্রোপচারের আমূল পরিবর্তন আসবে। ন্যানো উপাদান, ন্যানো রোবট, ন্যানো সার্জারি, ন্যানো ওষুধ ইত্যাদির প্রয়োগ দাঁতের চিকিত্সাব্যবস্থাকে নিয়ে যাবে ভিন্ন স্তরে।
লেখক: নুসরাত জাহান, সহকারী দন্ত চিকিৎকক, কিংস কলেজ লন্ডন, যুক্তরাজ্য
সূত্র: ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ডেন্টিস্ট্রি
১৯৬৭ সালের ৭ আগস্ট সকালবেলা, স্কটল্যান্ডের একটি ছোট শহরবাসীর ঘুম ভাংগল ১৫ বছরের একটি মেয়ের লাশ উদ্ধার হওয়ার খবরে।মেয়েটির নাম লিন্ডা,লিন্ডাকে খুব নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে।এছাড়াও তার বুকের ডানদিকে রয়েছে কামড়ের চিহ্ন।খুনী আর কোন ক্লু রেখে যায় নি।এই কেসটি সমাধান করেছিলেন ডাঃ ওয়ারেন হার্ভে।এটিই বৃটেনের প্রথম কেস যেটি সমাধানে সম্পূর্নভাবে ফরেনসিক ওডোন্টোলজির উপর নির্ভর করে রায় দেয়া হয়েছিল।
কেসের আগে এর সমাধানকারী ডাঃ ওয়ারেন হার্ভে সম্পর্কে কিছু বলা যাক।ডাঃ হার্ভে ১৯১৪ সালে স্ট্রাটফোর্ডশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন।তার পিতাও ছিলেন একজন ডাক্তার।স্রেসবুরীতে প্রাথমিক লেখাপড়া শেষে গাইস হাসপাতাল থেকে ডেন্টাল ডিগ্রী অর্জন করেন।।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডেন্টাল অফিসার হিসাবে যোগ দেন।যুদ্ধ শেষে রয়্যাল ম্যাসনিক হাসপাতালে কাজ করেন।১৯৬২ সালে তিনি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গ্লাসগো হাসপাতালের কনসালটেন্ট হিসাবে যোগ দেন।
গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় তিনি কেসটি সমাধানের দায়িত্ব পান।কেসটিকে বিচারকরা যথেষ্ট গুরত্বের সাথে নিয়েছিলেন,কিন্তু উপযুক্ত ক্লু এর অভাবে পুলিশ ও মামলাটির কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না।এই দিকে মিডিয়া এবং জনগন ও ধৈর্য্যহারা হয়ে যাচ্ছিল।অনেক চাপের মুখেই ডাঃ হার্ভে দায়িত্ব নেন।
আশ্চর্যজনকভাবে বাইট মার্ক ছাড়া ধর্ষণের কোন আলামত ও পাওয়া যায় নি।যে জায়গায় কামড়ের চিহ্ন পাওয়া গেসে সেখানে কখনোই লিন্ডার নিজের পক্ষে কামড়ানো সম্ভব না।এই চিহ্ন যে খুনীর ছাড়া অন্য কারো হতে পারে না এই বিষয়েও কোন সন্দেহ ছিল না।
সন্দেহভাজন ২৯ জনের ইম্প্রেশন নেয়া হয়। সেখান থেকে ৫ জনকে আলাদা করে হয়।কিন্তু ৫ জনের বাইট মার্ক এত কাছাকাছি যে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না।প্রযুক্তিও তখন এতটা অগ্রসর হয় নি।
হার্ভে খেয়াল করলেন বাইটমার্কে উপরের ডানচোয়ালের সেন্ট্রাল ইনসিসরের চিহ্ন ঠিক স্বাভাবিক না।এই অস্বাভাবিকতাই মামলার সকল জট খুলে দিল।তিনি আবার ইম্প্রেশন নেওয়ালেন,লিন্ডার ঘনিষ্ঠ বন্ধু গর্ডনের দাঁতের সাথে তা হুবহু মিলে যায়। হার্ভের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ গর্ডনকে গ্রেফতার করে।
গর্ডনের সেন্ট্রাল ইনসিসরে ম্যালডেভেলপমেন্টের কারনে একটি অতিরিক্ত অংশ বা কাসপ দেখা যায়।ডেন্টিস্ট্রিতে যাকে বলা হয় ট্যালন কাসপ।ট্যালন কাসপের জন্য লিন্ডার শরীরে কামড়ের কালশিটে জায়গায় স্বাভাবিকের বদলে কিছুটা গোলাকৃতি ছাপ দেখা যায়।এই ছাপই গর্ডনকে ধরিয়ে দেয়।
ডাঃ হার্ভে ৪০০ ঘন্টা গবেষণা করে প্রতিবেদন দাখিল করেন।পুলিশে জিজ্ঞাসাবাদে গর্ডন তার দোষ স্বীকার করে নেয়।লিন্ডা তার সাথে সম্পর্কে প্রতারণার জের ধরে এই হত্যাকান্ড ঘটায় বলে জানায়।
আড়াই ঘন্টা শুনানি শেষে বিচারকরা গর্ডনকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয় কিন্তু ১৮ বছর না হওয়ায় তাকে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়।
বৃটেনে এর আগে আদালতে ফরেনসিক ডেন্টিস্ট্রিকে আমলে নিলেও সেবারই প্রথম যখন শুধুমাত্র ডেন্টাল এভিডেন্সের ভিত্তিতে মামলার রায় দেয়া হয়।
এই রায়ের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আদালতে ফরেনসিক ডেন্টিস্ট্রির কদর বেড়ে যায়।ডাঃ হার্ভে তার মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ পূর্বে ১৯৭৪ সালে তার বহুল প্রতীক্ষীত Dental Identification and Forensic Odontology বইটি প্রকাশ করনে। এই বইটিকে অনেকে ফরেনসিক ডেন্টিস্ট্রির বাইবেল হিসাবে মনে করে।
ডাঃ হার্ভের একটি উক্তি –
“The law must keep pace with science…it usually lags a little behind but it does progress as scientific knowledge itself advances.”
তথ্য সংগ্রহে:
শাহ সাইফ জাহান
ঢাকা ডেন্টাল কলেজ
ইনসেই বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতবিনিময়
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের তথ্য কেন এনআইডিতে নয়, হাইকোর্টের রুল
বিএফডিএস’র আয়োজনে ডেন্টিস্টদের পদ্মা সেতু ভ্রমণ
রংপুর মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল ইউনিটের দশ বছর পূর্তি উদযাপিত
ঢামেকে “ওয়েগেনারস গ্রানুলোমেটোসিস” বিষয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত
বিএফডিএস কতৃক ইন্টার্ণ চিকিৎসকের নিয়ে কার্যকর আয়োজন
৪৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
ডেন্টাল রেকর্ডের মাধ্যমে নিখোঁজ ব্রিটিশ সাংবাদিক শনাক্ত
ঢাকায় ২৯ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি
৪৩৩ জনের করোনা শনাক্ত, হার ৬.২৭ শতাংশ
৪০তম বিসিএসে উত্তীর্ণদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু ২৬ জুন
দন্তচিকিৎসক বুলবুল হত্যায় আরও একজন গ্রেপ্তার
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে স্বাস্থ্যের সাবেক ডিজিসহ ৬ জনের বিচার শুরু
ডেন্টাল ইউনিটের বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি নষ্ট, সেবা ব্যাহত
আন্দোলনের তৃতীয় দিনে সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ডেন্টাল ইউনিটের শিক্ষার্থীরা
পঞ্চম শ্রেণি পাশ না করেই তিনি অভিজ্ঞ ডেন্টিস্ট!
খুলনা ডেন্টাল কলেজ নির্মাণের উদ্যোগ কতটুকু এগিয়েছে?
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেন্টাল ইউনিটে চিকিৎসা সেবার উদ্বোধন
দেশে অসংক্রামক রোগে ৬৭ শতাংশ মানুষের মৃত্যু: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
বিডিএস ৩য় ফেজ এর শিক্ষার্থীদের জন্যে পেরিওডন্টোলজী এন্ড ওরাল প্যাথলজীর বই এর মোড়ক উন্মোচন
সম-সাময়িক
-
জাতীয়2 months ago
মাটিরাঙ্গায় ২ ডেন্টাল ক্লিনিক সিলগালা ; দেড় লাখ টাকা জরিমানা
-
সংগঠন2 months ago
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে স্পেশাল হেলথ কেয়ার ফাউন্ডেশন
-
জাতীয়2 months ago
খাগড়াছড়িতে ২ ভুয়া দন্ত চিকিৎসককে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড
-
জাতীয়2 months ago
মির্জাপুরে ৩ টি ডেন্টাল চেম্বার সহ ১১ প্রতিষ্ঠান সিলগালা