রেমালের প্রভাবে প্লাবিত উপকূলের সিংহভাগ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র

ডেন্টাল টাইমস

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে প্লাবিত হয়েছে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সিংহভাগ স্বাস্থ্য কেন্দ্র। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় গতকাল পর্যন্ত অনেক এলাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রকৃত চিত্র জানতে পারেনি বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। 

চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনার বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের পর জরুরি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে হাজারের বেশি জরুরি চিকিৎসা দল (ইমারজেন্সি মেডিকেল টিম—ইএমটি) কাজ করছে। তবে রেমালের আঘাতে দুর্গত এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা কতটা বিপর্যস্ত হয়েছে তা নিরূপণে আরো কয়েক দিন সময় লাগবে।

রেমালের প্রভাবে অন্তত ১৯ জেলায় ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে। 

জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বলছে, রেমালের আঘাতে উপকূলীয় অঞ্চলে ৮৪ লাখের বেশি মানুষ স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্যানিটেশন ও নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পড়েছে। এর মধ্যে ৩২ লাখ শিশু।

গতকাল চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপকূলীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করা যায়নি। ঝড়ের কারণে এসব এলাকার বিদ্যুৎ, টেলিফোন কিংবা মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন রয়েছে। 

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিভাগের ছয় জেলায় ৩৬টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৭০টি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ৩৪৭টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে এসব চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রায় সবই প্লাবিত হয়েছে। 

এ বিভাগের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, দুর্যোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগে থেকে ৪৫০টি জরুরি চিকিৎসা দল প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। তারা দুর্গত এলাকায় মানুষের জরুরি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কাজ করছে। 

কর্মকর্তারা জানান, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর, বরিশাল ও ঝালকাঠির প্রায় সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচতলা প্লাবিত হয়। 

নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় পুরো বিভাগের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র এখনই বলা যাচ্ছে না বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো উপজেলায় বিদ্যুৎ নেই, টেলিফোনেও যোগাযোগ করতে পারছি না। স্বাস্থ্যসেবার সার্বিক পরিস্থিতি এখনো জানা যায়নি। বরিশাল জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোও প্লাবিত হয়েছে। ঝড়ের পরে রোগীর চাপ বাড়েনি। দুর্যোগ পরিস্থিতি পুরোপুরি কেটে গেলে রোগীর সংখ্যা বাড়তে পারে। তবে যথাযথ প্রস্তুতি থাকায় জনস্বাস্থ্য নিয়ে বড় ধরনের ঝুঁকি নেই।’

চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় জানায়, এ বিভাগে ১ হাজার ২১৭টি জরুরি চিকিৎসা দল কাজ করছে। এর মধ্যে ৭২৮টি দল কাজ করছে উপকূলীয় অঞ্চলে। 

চট্টগ্রাম বিভাগে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার দ্বীপ ও চরাঞ্চলের অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্লাবিত হয়। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্লাবিত হয় কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন ও নোয়াখালীর হাতিয়ায়।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ের উপপরিচালক ডা. ইফতেখার আহমদ গতকাল বিকালে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উপজেলাগুলোয় এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা তেমন ব্যাহত হয়নি। তবে বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল ও দ্বীপগুলোয় যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পানি ওঠায় কোথাও কোথাও রোগীরা সেবা নিতে আসতে পারছে না।’ 

সরজমিনে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর রমিজ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে দেখা যায়, সেখানে পানি প্রবেশ করায় প্রসূতিরা সেবা নিতে পারছেন না। জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক মো. লোকমান হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের কারণে স্বাভাবিকভাবে সেবাগ্রহীতরা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কম যাচ্ছে। কোথাও কোথাও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্লাবিত হয়েছে। তবে প্রসূতি সেবা ও অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা যেন বন্ধ না হয়, সেজন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে।’

এদিকে দুর্যোগে আহত হয়ে অনেক রোগী হাসপাতালে আসছে বলে জানিয়েছেন চাঁদপুর জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. একেএম মাহবুবর রহমান। 

উপকূলীয় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো পানিতে ডুবেছে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছে খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়। বিভাগটিতে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বাদে ১০টি জেলা হাসপাতাল ও ৫০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। এসব উপজেলায় ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক মিলিয়ে সেবা কেন্দ্র রয়েছে কয়েক হাজার। উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো পানিতে প্লাবিত হওয়ায় স্বাভাবিক সেবা ব্যাহত হয়েছে। 

বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলা এবং খুলনার কয়রা উপজেলার অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. মনজুরুল মুরশিদ। তিনি বলেন, ‘উপকূলীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো প্লাবিত হয়েছে। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছি। মোড়েলগঞ্জে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দেয়াল ভেঙে পড়েছে বলে জেনেছি। বিভিন্ন উপজেলায় কয়েকজন আহত হয়েছেন।’ 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, ঘূর্ণিঝড়ের পর স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার প্রস্তুতি নিতে মাঠ পর্যায়ে আগেই নির্দেশনা জারি করা হয়। তাতে পর্যাপ্ত মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখার কথা বলা হয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি বিভাগে অতিরিক্ত জনবল রাখার নির্দেশনাও ছিল। বলা হয়েছিল পর্যাপ্ত খাওয়ার স্যালাইন, ওষুধের মজুদ ও বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থার কথাও। 

এই সংবাদটি শেয়ার করুন
এই সংবাদ নিয়ে আপনার মন্তব্য লিখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version