চিকিৎসক মননে সংবিধান ভাবনা

ডেন্টাল টাইমস

বাংলাদেশের সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন। এটি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, কর্তব্য এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণ করে। একজন চিকিৎসকের কাছে সংবিধান শুধু আইনি কাঠামো নয়, বরং এটি তাঁর নৈতিক দায়িত্বের প্রতীকও বটে। যেমন হিপোক্রেটিসের শপথ চিকিৎসককে মানবসেবায় নিবেদিত হতে বাধ্য করে, তেমনি সংবিধানও তাঁকে ন্যায়, সমতা এবং মানবমর্যাদা রক্ষার পথে পরিচালিত করে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ইতিহাস

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর নতুন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি লিখিত সংবিধানের প্রয়োজন দেখা দেয়।
ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয় এবং ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হয়। একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবসে, এটি কার্যকর হয়।

এই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে— গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শ— যা চিকিৎসকের পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

চিকিৎসা ও সংবিধানের মূল নীতি

অনুচ্ছেদ ১৫ –মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা
রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো নাগরিকদের খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা প্রদান করা।
অতএব, চিকিৎসা কেবল পেশা নয়, এটি সংবিধান দ্বারা প্রদত্ত একটি মৌলিক মানবাধিকার।
চিকিৎসকের দায়িত্ব হলো এই অধিকারের যায়গায় প্রয়োজন। যা করতে চিকিৎসক সচেস্ট থাকবেন

অনুচ্ছেদ ১৮ – জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা
রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্বগুলোর মধ্যে জনগণের পুষ্টির মান বাড়ানো এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি করা অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও, রাষ্ট্রকে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে মদ্যপান, মাদকদ্রব্য ও অন্যান্য ক্ষতিকর জিনিসের ব্যবহার বন্ধ হয় — তবে চিকিৎসার কাজে বা আইনে অনুমোদিত ক্ষেত্রে এগুলোর ব্যবহার করা যেতে পারে

অনুচ্ছেদ ১৩ – মালিকানার নীতি
রাষ্ট্র, সমবায় ও ব্যক্তি— এই তিন ধরনের মালিকানা সংবিধানে স্বীকৃত।

  • রাষ্ট্রীয় মালিকানা: সরকার জনগণের কল্যাণে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে।
  • সমবায়ী মালিকানা: সদস্যদের সম্মিলিত উদ্যোগে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা যায়।
  • ব্যক্তিগত মালিকানা: ব্যক্তি আইনসঙ্গতভাবে নিজ উদ্যোগে ক্লিনিক বা হাসপাতাল স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারেন।
    এভাবে সরকারি ও বেসরকারি— উভয় ক্ষেত্রই জনগণের সেবায় সমানভাবে নিয়োজিত।

অনুচ্ছেদ ১৯সমঅধিকার
রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করবে।
তাই চিকিৎসকদের কর্তব্য হলো ধর্ম, লিঙ্গ, জাতি বা সম্পদ নির্বিশেষে সকল রোগীকে সমানভাবে সেবা দেওয়া।
নারীর সমান অংশগ্রহণও এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংরক্ষিত।

অনুচ্ছেদ ২০ – কাজের অধিকার ও কর্তব্য
কাজ নাগরিকের অধিকার যেমন, তেমনি দায়িত্বও। চিকিৎসকের পেশা শুধুমাত্র জীবিকা অর্জনের উপায় নয়; এটি মানবতার প্রতি এক গৌরবময় অঙ্গীকার। তাঁর জ্ঞান ও দক্ষতা মানুষের আরোগ্যের কল্যাণে নিবেদিত হওয়া উচিত।

নাগরিক ও চিকিৎসকের কর্তব্য

অনুচ্ছেদ ২১ – নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীর কর্তব্য
প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং জনসেবায় নিয়োজিত থাকা।
সরকারি চিকিৎসকদের উচিত রোগীর সেবায় আন্তরিক থাকা, সরকারি সম্পদ সততার সঙ্গে ব্যবহার করা এবং মানবতার সেবায় নিবেদিত থাকা।বেসরকারি চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও একইভাবে নৈতিকতা, সততা ও মানবিক দায়িত্ব পালন অপরিহার্য।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে সমতা ও ন্যায়বিচার

  • অনুচ্ছেদ ২৯সরকারি চাকরিতে সমতা
    প্রত্যেক নাগরিক সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকার রাখে।
    ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থান অনুযায়ী কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না।
    তবে রাষ্ট্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা দিতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের জন্য পৃথক পদ সংরক্ষণ করতে পারে।
    এভাবে চিকিৎসক নিয়োগে ন্যায়, যোগ্যতা ও সমতা রক্ষিত হয়।
  • অনুচ্ছেদ ৩২জীবন ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার
    কোনো ব্যক্তিকে আইন ছাড়া জীবন বা স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
    চিকিৎসকের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব জীবন রক্ষা করা।
    অতএব, জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দেওয়া চিকিৎসকের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব।
  • অনুচ্ছেদ ৪০পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা
    প্রত্যেক নাগরিক আইনসম্মত যেকোনো পেশা বেছে নিতে পারেন।
    সুতরাং, সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসক উভয়েই সংবিধানের সুরক্ষায় থেকে সেবা প্রদান করতে পারেন, যতক্ষণ তাঁরা আইন ও নৈতিকতার সীমারেখা মেনে চলেন।

আইনি সুরক্ষা ও দায়িত্ব

  • অনুচ্ছেদ ১৩৩নিয়োগ চাকরির শর্তাবলি
    সংসদ সরকারি চাকরির নিয়োগ ও শর্ত নির্ধারণ করতে পারে।
    আইন প্রণীত না হলে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনীয় বিধি নির্ধারণের ক্ষমতা রাখেন।
  • অনুচ্ছেদ ১৩৪চাকরির মেয়াদ
    রাষ্ট্রপতির অনুমোদন অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ নির্ধারিত হয়, যা চাকরির স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে।
  • অনুচ্ছেদ ১৩৫সরকারি কর্মচারীর অপসারণ
    কোনো চিকিৎসককে অন্যায়ভাবে চাকরি থেকে অপসারণ করা যাবে না; তাঁকে অবশ্যই নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ দিতে হবে।
    তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম প্রযোজ্য হতে পারে।
  • অনুচ্ছেদ ১৩৬চাকরি পুনর্গঠন
    রাষ্ট্র চাইলে স্বাস্থ্য বিভাগ বা হাসপাতালসমূহ পুনর্গঠন বা একীভূত করতে পারে, যাতে সেবার মান ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।

সরকারি কর্মকমিশন ও চিকিৎসক নিয়োগে স্বচ্ছতা

অনুচ্ছেদ ১৩৭কমিশন প্রতিষ্ঠা
সংবিধান অনুযায়ী এক বা একাধিক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা হবে, যাদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ আইন অনুযায়ী দেওয়া হবে।

অনুচ্ছেদ ১৪০কমিশনের কার্যাবলি
কমিশনের দায়িত্ব—

  • সরকারি চাকরির জন্য যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন ও পরীক্ষা গ্রহণ।
  • রাষ্ট্রপতিকে নিয়োগ, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান।
  • প্রয়োজনে অন্যান্য দায়িত্ব পালন।
    এভাবে চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, যোগ্যতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।

জরুরি অবস্থায় চিকিৎসকের ভূমিকা

  • অনুচ্ছেদ ১৪১(ক) – জরুরি অবস্থা ঘোষণা
    যদি রাষ্ট্রপতি মনে করেন যে যুদ্ধ, বিদেশি আগ্রাসন বা অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কারণে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিপন্ন, তবে প্রধানমন্ত্রী’র পরামর্শে তিনি সর্বোচ্চ ১২০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।
    এই সময়ে চিকিৎসকদের প্রথম দায়িত্ব হলো— আহত ও অসুস্থ মানুষকে ভয় নয়, বরং দায়িত্ববোধ থেকে সেবা প্রদান করা।
  • অনুচ্ছেদ ১৪১() – জরুরি অবস্থায় আইন
    জরুরি অবস্থায় সরকার বিশেষ আইন প্রণয়ন করতে পারে, এবং চিকিৎসকদের সেই পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা দিতে হতে পারে— যেমন দুর্যোগপীড়িত এলাকায় সেবা প্রদান বা স্বাস্থ্যসেবার সার্বিক পরিচালনা।
  • অনুচ্ছেদ ১৪১() – মৌলিক অধিকার স্থগিত
    জরুরি অবস্থায় কিছু মৌলিক অধিকার সাময়িকভাবে স্থগিত হতে পারে, তবুও চিকিৎসকের মানবিক দায়িত্ব থেকে যায়— রোগীর জীবন বাঁচানো ও চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখা।

হিপোক্রেটিসের শপথ ও সংবিধানের সংযোগ

হিপোক্রেটিসের শপথ চিকিৎসককে শেখায়—

  • মানুষের মঙ্গল ও জীবন রক্ষা করা (অনুচ্ছেদ ৩২)
  • সততা ও গোপনীয়তা বজায় রাখা (অনুচ্ছেদ ২১)
  • সকলকে সমানভাবে চিকিৎসা দেওয়া (অনুচ্ছেদ ১৯ ও ২৯)
  • বিপদের সময়ে মানবতার পাশে থাকা (অনুচ্ছেদ ১৪১ ক-গ)

অর্থাৎ, সংবিধান ও শপথ— দুটি পথেই চিকিৎসকের বিবেক, দায়িত্ব ও মানবিকতা একত্রে বিকশিত হয়।

চিকিৎসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য

সরকারি চিকিৎসকের দায়িত্ব

  • জনগণকে আন্তরিকভাবে সেবা দেওয়া (অনুচ্ছেদ ২১)।
  • সরকারি সম্পদের সঠিক ও সততার সঙ্গে ব্যবহার।
  • সকল রোগীর প্রতি সমান আচরণ ও সেবা (অনুচ্ছেদ ১৯, ৩২)।
  • সততা, গোপনীয়তা ও পেশাগত মর্যাদা বজায় রাখা।
  • জরুরি অবস্থায় প্রাণরক্ষায় নিরলস ভূমিকা রাখা (অনুচ্ছেদ ১৪১ ক-গ)।
  • প্রশাসনিক নিয়ম ও হাসপাতালের শৃঙ্খলা মেনে চলা।
  • মানবিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধে অবিচল থাকা।

বেসরকারি চিকিৎসকের দায়িত্ব

  • সকল রোগীর প্রতি সমান ও ন্যায়সঙ্গত সেবা প্রদান।
  • রোগীর ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা।
  • অন্যায়ভাবে আর্থিক লাভ না করা।
  • আইন ও নৈতিকতার মধ্যে থেকে পেশা পরিচালনা করা (অনুচ্ছেদ ৪০)।
  • জাতীয় সংকটে স্বেচ্ছাসেবী ভূমিকা পালন।
  • নিয়মিত শিক্ষা ও দক্ষতার মাধ্যমে নিজেকে আধুনিক করে তোলা।
  • সততা, মানবিকতা ও পেশাগত দায়িত্ববোধ বজায় রাখা।

উপসংহার

বাংলাদেশের সংবিধান ও হিপোক্রেটিসের শপথ— উভয়ই চিকিৎসকের নৈতিক ও আইনি পথপ্রদর্শক।
সংবিধান চিকিৎসককে দেয় অধিকার ও দায়িত্বের ভিত্তি, আর শপথ জাগিয়ে রাখে তাঁর মানবিক বিবেক।
একজন প্রকৃত চিকিৎসক সেই ব্যক্তি, যার চিন্তায় সংবিধানের ন্যায়বোধ ও হৃদয়ে মানবতার আহ্বান একত্রে বিরাজ করে। তিনি কেবল রোগ নিরাময়কারী নন— তিনি জাতির সেবক, মানবতার রক্ষক এবং জীবনের অভিভাবক।

সম্পর্কিত
এই সংবাদটি শেয়ার করুন
এই সংবাদ নিয়ে আপনার মন্তব্য লিখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version