বুয়েটের আবরার ফাহাদের হত্যাকান্ড যখন ঘটে তখন দেশে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তা খুব দ্রুত লাইম লাইটে আসে। কিন্তু ২০১১ সালে চট্টগ্রামে বিডিএস শিক্ষার্থীর উপর এমন নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটে গেলেও তা অনেকটা আড়ালেই রয়ে যায়।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) ছাত্রাবাসে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর পিটুনির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আবিদুর রহমান আবিদ। তিনি ছিলেন চমেকের ৫১তম ব্যাচের ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি (বিডিএস) ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী।
স্বজনদের অভিযোগ, ছাত্রদলের কমিটি গঠনের চেষ্টা করায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা কয়েক দফা পিটিয়েছিলেন আবিদকে। এরপর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বোনের বাসায়। দুইদিন পর ২১ অক্টোবর রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবিদ।
এ ঘটনায় আবিদের মামা নেয়ামত উল্লাহ বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় ছাত্রলীগ ও ছাত্রসংসদের ২২ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
অভিযুক্তরা হলেন- তৎকালীন ছাত্র সংসদের ভিপি মফিজুর রহমান জুম্মা, চমেক ছাত্রলীগ সভাপতি সোহেল পারভেজ, সাধারণ সম্পাদক বিজয় সরকার, সহ সাধারণ সম্পাদক হিমেল চাকমা, ফেরদৌস রাসেল, শান্ত দেবনাথ, মাহাফুজুর রহমান, নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, দেবাশীষ চক্রবর্তী, মোস্তফা কামাল, রাশেদুর রহমান সানি ও সালমান মাহমুদ রাফসান।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আসামিদের দোষ প্রমাণ করতে না পারায় চলতি বছরের ১০ জুলাই আবিদ হত্যা মামলার রায়ে ৫ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক সব আসামিকে খালাস দেন।
ছাত্রদল চমেক শাখার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আহমেদ দাবি করেছিলেন, আবিদ তাদের সক্রিয় কর্মী ছিল। আবিদসহ ছাত্রদল কর্মী ফয়সাল, নাজিম ও মাসুমকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে ছাত্রলীগ। পরে আবিদ মারা যায়।
এ ঘটনায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা মেডিকেল কলেজ প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিক্ষোভ করে। একাডেমিক কাউন্সিলের সভা শেষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সেলিম মো. জাহাঙ্গীর অনির্দিষ্টকালের জন্য মেডিকেল কলেজ বন্ধ এবং ছাত্র সংসদ কার্যক্রম স্থগিত ও কলেজ ক্যাম্পাসে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট অশোক কুমার দাশ বাংলানিউজকে বলেছিলেন, সাক্ষীরা কোনো আসামি শনাক্ত করতে পারেননি। তারপরও রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সাক্ষ্য ও জেরায় আসামিদের বিরুদ্ধে দোষ প্রমাণিত না হওয়ায় মফিজুর রহমান গংদের এ মামলার দায় হতে খালাস দেওয়া হয়।
তবে এ রায়ে সন্তুষ্ট ছিলো না আবিদের পরিবার। নিহতের ভাই মো. জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের মতো পরিণতি হয়েছিল আবিদের। কখন রায় ঘোষণা হলো তা আমরা জানতেও পারিনি।
তিনি বলেন, মামলার বাদী আমার মামা নেয়ামত উল্লাহ ২২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার এজাহার দায়ের করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ ১০জন আসামিকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দিয়েছে। আদালতে সাক্ষ্য দিতে গেলে বাধা ও হুমকি দেওয়া হয়। রায়ে আসামিরা সবাই খালাস পাওয়ার কথা শুনে ষাটোর্ধ্ব মা সৈয়দুন্নেছা শুধু কাঁদছেন।
আবিদের বন্ধুদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আবিদ ছাত্রদলকে গোছাতে সক্রিয় ছিলেন। কারণ তখন ছাত্রদলের চমেক কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। যা সহ্য করতে পারেননি চমেক ছাত্রলীগের নেতারা। তাকে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর দুপুর ২টা, সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ১০টায় তিন দফা নির্যাতন করে। নির্যাতনের পর সুযোগ না দিয়ে আবিদকে তার বোনের বাসায় পাঠিয়ে দেয়। যা আবিদ হত্যা মামলার এজাহারেও উল্লেখ আছে।
চার বোন তিন ভাইয়ের সাবার ছোট ছিল আবিদ। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মধ্যম বড়ইতলী গ্রামের মৃত নুরুল কবির চৌধুরীর ছেলে। চকরিয়া উপজেলার বড়ইতলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে তিনি চমেকে ভর্তি হয়েছিলেন। আবিদ মেজ বোন মোরশেদা ইয়াসমিন, ছোটবোন রায়হান জান্নাত আর বড় বোন সাজেদা ইয়াসমিনের ছেলে শাফকাতকে নিয়ে নগরীর চকবাজার এলাকার ডিসি রোডে বসবাস করতেন। মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর আবিদ ছাত্রাবাসে উঠেন। কিন্তু বাসা ছাড়েননি। এরই মাঝে মেজ বোনের বিয়ে হলে তিনিও পাশাপাশি বাসা নিয়ে বসবাস করতেন। আবিদ মারা যাওয়ার পর তার আরেক বন্ধুকে দিয়ে তার লাশ ছাত্রলীগ নেতারা মেজ বোনের বাসায় পাঠায়।
সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে আবিদের মেজ বোনের স্বামী কামরুল হাসান সোহেল বলেন, ‘১৯ অক্টোবর ২০১১ আমার শ্বশুর বাড়ি এলাকার সালমান নামের এক শিক্ষার্থীর মাধ্যমে আবিদকে ছাত্রলীগ বাসায় পাঠায়। সালমান ভয়ে কথা বলতে পারছিলোনা। শুধু বলেছিল, আবিদকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখলাম তার গায়ে আঘাতের চিহ্ন আছে। তখন চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাই। ছাত্রলীগ মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে দেয়নি। পরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিই। সেখান থেকে আবার চমেক রেফার করে। দুই দিন অজ্ঞান থাকার পর ২১ অক্টোবর আবিদকে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।’