স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বেশ কিছু দিন ধরে চলা স্থবিরতা নিরসনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. রোবেদ আমিনের অপসারণসহ ৭ দফা দাবি জানিয়েছে বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। দাবি মানা না হলে চিকিৎসক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে আগামীতে আন্দোলন বিস্তৃত করারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।
শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশিদের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের মহাসচিব ডা. মো. আবদুস সালাম। সংবাদ সম্মেলনে ডা. রোবেদ আমিনের পেশাগত অসঙ্গতি ও দুর্নীতি তুলে ধরা হয়।
লিখিত বক্তব্যে ডা. মো. আবদুস সালাম বলেন, চিকিৎসকরা এদেশের সচেতন নাগরিক। এ দেশের ভাষা আন্দোলনে, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকদের আত্মত্যাগ, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের আত্মত্যাগ যেমন আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ দিয়েছিল, তেমনি এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চিকিৎসক সমাজ ও মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং ডা. সজীব সরকারসহ ৮ জন চিকিৎসক শহীদ হন।
ড্যাবের চিকিৎসকসহ ভিন্নমত পোষণকারী চিকিৎসকরা কর্মকর্তা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের জুলুম, নির্যাতন, পদোন্নতি বঞ্চনা, বদলি হয়রানি ও মিথ্যা মামলায় গত ১৬ বছর অবর্ণনীয় বৈষম্যের শিকার হয়েছে। অনেকে চাকুরিচ্যুত হয়েছেন, নির্যাতনের কারণে অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। তারপরও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ড্যাবের চিকিৎসকরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই ড্যাব এই আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন দেয় এবং ড্যাবের চিকিৎসকরা বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহযোগিতা করেছে। ড্যাবের চিকিৎসকরা পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সারা বাংলাদেশে পুলিশ ও আওয়ামী গুন্ডাবাহিনী দ্বারা হাজার হাজার যে ছাত্রজনতা আহত হয়েছে তাদের চিকিৎসা, জরুরি অপারেশন ও পরবর্তীতে পুনর্বাসনে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে; যা এখনো চলমান রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ড্যাব সেই সরকারকে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানায় এবং স্বাস্থ্য খাতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। যেহেতু ফ্যাসিবাদের দোসর চিকিৎসকরা এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিএসএমএমইউসহ সকল স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে স্বপদে বহাল রয়েছে। আমরা চিকিৎসকরা আশা করেছিলাম, গণঅভ্যুত্থানে পর অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের মাননীয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আওয়ামী সরকারের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাতকে পুনর্গঠন এবং দুর্নীতিবাজ চিকিৎসকদের অপসারন এবং দুর্নীতি তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন এবং সৎ, যোগ্য, পরিশ্রমী ও বঞ্চিত চিকিৎসকদের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, হাসপাতালের পরিচালক এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ পূরণ করে একটি আস্থাশীল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন এবং বৈষম্যের শিকার চিকিৎসকদের যথাযথ মূল্যায়ন করে যোগ্য পদে পদোন্নতি দিয়ে পদায়ন করে তাদের মেধাকে কাজে লাগাবেন এবং ভঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সচল করবেন। কিন্তু আমরা গণঅভ্যুত্থানের এক মাস হয়ে গেলেও তার কোনো প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না। বরং শান্তি মিছিলে অংশগ্রহণকারী, দুর্নীতিবাজ চিকিৎসকদের পদায়ন করার মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। গত ১৬ বছর বৈষম্যের শিকার চিকিৎসকদের যথাযথ বদলি ও পদোন্নতির ব্যবস্থা না করে তাদের বঞ্ছনাকে দীর্ঘায়িত করছে এবং নানাভাবে হয়রানি করছে।
৩ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরোধীতা করে ফ্যাসিবাদের দোসর চিকিৎসকদের অংশগ্রহণে যে শান্তি সমাবেশ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী হিসাবে চিহ্নিত বর্তমানে নিয়োগপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক। ছাত্র জনতার আন্দোলন যে চেতনার বিরুদ্ধে, সেই ফ্যাসিবাদী চেতনার ব্যক্তি, উচ্চাভিলাষী, পদলোভী চিকিৎসককে বৈষম্যবিরোধী চিকিৎসক সমাজ কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে স্থবিরতা ও ছাত্রআন্দোলনে বিরোধিতাকারী পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসন এবং চিকিৎসক, কর্মকর্তাদের প্রতি বৈষম্য ও হয়রানির প্রতিবাদে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
স্বাস্থ্যখাতে স্থবিরতা ও সংকট নিরসনে ড্যাবের ৭ দাবি হলো-
১। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদের অযোগ্য দুর্নীতিবাজ ফ্যাসিবাদের দোসর ডা. রোবেদ আমীনসহ অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্ত ও ফ্যাসিবাদের দোসর যাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ও অন্যান্য স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে তাদের নিয়োগ আদেশ বাতিল করতে হবে।
২। আহত ছাত্র-জনতাকে যারা চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেছে (বিএসএমএমইউ থেকে শুরু করে সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান) তাদের তালিকা প্রণয়ন করে বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে। শান্তি সমাবেশে যোগদানকারী ও ফ্যাসিবাদের দোসর সকল চিকিৎসক ও কর্মকর্তা/কর্মচারীকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দিতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩। অতি দ্রুত বৈষম্যের শিকার সকল চিকিৎসক ও কর্মচারীদের ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দিয়ে বৈষম্য দূর করতে হবে। বর্তমানে পদোন্নতিযোগ্য প্রত্যেককেই দ্রুততার সঙ্গে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই বঞ্চিত, দক্ষ, যোগ্য কর্মকর্তাদের পদায়ন করে স্বাস্থ্য প্রশাসন ঢেলে সাজানো সম্ভব হবে, যা অতি জরুরি।
৪। মেডিকেল কলেজসহ প্রতিটি হাসপাতাল দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এ সকল প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত করতে যোগ্য ও বৈষম্যের শিকার শিক্ষক ও চিকিৎসকদের যথোপযুক্ত পদে পদায়িত করতে হবে। বিগত দীর্ঘ ১৬ বছর সময়ে স্বাস্থ্য খাতে যত দুর্নীতি হয়েছে তার শ্বেতপত্র প্রকাশ ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৫। মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট, নার্সিং কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অতি দ্রুত স্বৈরাচারের দোসরদের সরিয়ে বৈষম্যের শিকার চিকিৎসকদের পদায়ন করতে হবে।
৬। প্রতিবাদকারী যেসব চিকিৎসকদের হয়রানিমূলক বদলি করা হয়েছে সেই বদলি আদেশ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। ভবিষ্যতে বৈষম্যের শিকার চিকিৎসকদের কোনভাবেই হয়রানিমূলক বদলি করা যাবে না।
৭। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ও চিকিৎসাসেবার গুণগতমান উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালীকরণের জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল কমিটি অতি দ্রুত বাতিল করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশকারী চিকিৎসক সমাজের প্রতিনিধিত্ব রেখে কমিটি পুনঃগঠনের জোর দাবি জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ড্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ডা. এম এ সেলিম, সহসভাপতি ডা. সিরাজুল ইসলাম, ডা. মোস্তাক রহিম স্বপন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ডা. মো. মেহেদী হাসান, যুগ্ম মহাসচিব ডা. পারভেজ রেজা কাকন, ডা. আবদুল কেনান, ডা. সায়ীদ মেহবুব উল কাদির, ডা. আদনান হাসান মাসুদ, কোষাধ্যক্ষ ডা. জহিরুল ইসলাম শাকিল, ডা. সাইফুদ্দিন ঝিন্টু, দপ্তর সম্পাদক ডা. এরফান আহমেদ সোহেল, ডা. নিউটন, ডা. জাহেদুল কবির জাহিদ, ডা. জাভেদ হোসেন, এম এ কামাল, ডা. রন্জু, ফারুক, ডা. মাসুদ রানা, ডা. এসএম মাসুম বিল্লাহ, ডা. ফরিদ উদ্দিন, ডা. ওহীদুজ্জামান ইমন, ডা. সৌরভ, ডা. শামসুল, ডা. আতিক, ডা. এএসএম রাকিবুল ইসলাম আকাশসহ আরও অনেক চিকিৎসক।