বছর দশেক আগে স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় যখন ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে, তখন বারবার আলোচনায় আসে একটি চক্রের কথা। স্বাস্থ্য খাতের সব কেনাকাটা ছিল চক্রটির কবজায়। ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু এই চক্রের নেতা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্যের কেনাকাটা কবজায় নিতে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে সেই ‘মিঠু চক্র’।
২০২০ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ উপার্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাস্ক-পিপিই কেনায় দুর্নীতির অনুসন্ধানে দুদক তলব করলে দেশ ছাড়েন ঠিকাদার মিঠু। নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত অক্টোবরে দেশে ফিরেছিলেন মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। ওই সময় তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন। ঠিক ওই সময়ই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন তাঁর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করে। খবরটি জানার পর দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও দুদক নড়েচড়ে বসে। মিঠুর সম্পদ জব্দ ও বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। কৌশলে আবার দেশ ছাড়েন মিঠু। দ্বিতীয় দফা দেশ ছাড়ার আগে মিঠু তাঁর অনেক সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তবে মিঠু দেশে না থাকলেও তাঁর চক্রের লোকজন আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মিঠু চক্রের জালিয়াতির কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠানের বাইরে ‘বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস’সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের হয়ে দরপত্র দাখিল করছে চক্রটি। স্বাস্থ্য খাতের দরপত্রে ঘুরেফিরে মিঠু চক্রের প্রতিষ্ঠানই অংশ নিচ্ছে এবং কাজ পাচ্ছে।
সম্প্রতি ‘পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয়ে তিন মাসে ৯টি দরপত্র আহ্বান করা হয়। এসব দরপত্রে মোট ৯৬ কোটি টাকার মালপত্র কেনা হবে। ওই ৯টি দরপত্রের মধ্যে পাঁচটির কাজ পেয়েছে ‘বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস’। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বাকি চারটি দরপত্রের কাজও ঠিকাদার মিঠু চক্রের প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস’কে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্পের বেশ কিছু দরপত্রের কাজও ওই কোম্পানিকে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ সায়েন্স হাউসের ব্যবস্থাপনা সহযোগী আমিনুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেন, ‘উন্মুক্ত দরপত্রে কাজ পেয়েছি। কারও সুপারিশ বা সিন্ডিকেটের প্রয়োজন হয়নি।’
কিছুদিন আত্মগোপনে থাকেন মিঠু। আত্মগোপনে থেকেই তিনি কছির উদ্দিন মেডিকেল কলেজের জমিসহ আটতলা ভবন ও একই এলাকায় ২০ কেভি বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন সংলগ্ন জমি বিক্রির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু গত বছর অক্টোবরে দেশে ফিরে নিজ এলাকা রংপুরে তাঁর বাবার নামে গড়ে তোলা কছির উদ্দিন মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধনের উদ্যোগ নেন। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়। জাহিদ মালেক অনুষ্ঠানে যেতে সম্মতিও দেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি প্রতিনিধি দল ওই মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয়। বেশ বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার মিঠুর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করে। এতে মিঠু দেশে ফেরার কথা জানাজানি হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কছির উদ্দিন মেমোরিয়াল মেডিকেলের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধন অনুষ্ঠান বাতিল হয়। এর পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকেন মিঠু। আত্মগোপনে থেকেই তিনি কছির উদ্দিন মেডিকেল কলেজের জমিসহ আটতলা ভবন ও একই এলাকায় ২০ কেভি বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন সংলগ্ন জমি বিক্রির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এর পর কৌশলে আবার বিদেশ চলে যান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিদেশ যাওয়ার আগে ঠিকাদার মিঠু মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে চিকিৎসাযন্ত্র ও সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহকারী ৬১টি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু, তাঁর বড় ভাই মোকছেদুল ইসলাম ও ভাগনে বেনজির আহমেদ। এই নেটওয়ার্কের রাজশাহী অঞ্চলের কার্যক্রম দেখেন ঠিকাদার নাসিমুল ইসলাম গণি টোটন। ২০২১ সালের অক্টোবরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৭টি ফাইল গায়েবের ঘটনায় টোটনকে ঢাকায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। কিন্তু মিঠুর প্রভাবে তখন ব্যবসায়ী টোটনের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি বলে জানা যায়। ওই সব ফাইলে ছিল শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, মানিকগঞ্জ কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নীলফামারী মেডিকেল কলেজ, নওগাঁ সদর হাসপাতাল ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কেনাকাটা-সংক্রান্ত নথি। আরও ছিল ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিং, জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি, নিপোর্টের কেনাকাটা এবং ট্রেনিং স্কুলের যানবাহন বরাদ্দ ও ক্রয়সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র।
গোপন বৈঠকের পর স্বাস্থ্যে বড় রদবদল
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গত আট মাসে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে রদবদলের ঘটনা ঘটেছে। করোনার সময় ক্ষমতার অপব্যবহার ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া ডা. শাহ গোলাম নবী তুহিনকে সম্প্রতি অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁকে কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পে বর্তমানে অনেক কেনাকাটা হচ্ছে। এ ছাড়া অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার উপপরিচালক দাউদ আদনানকে করা হয়েছে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক। হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্টের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক তপনকে সরিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক নাজমুল ইসলামকে এই পদে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) থেকে সরিয়ে মো. শামিউল ইসলামকে করা হয়েছে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক।
এসব বদলির পেছনে মিঠু চক্রের হাত রয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. হারুন অর রশীদ সমকালকে বলেন, ‘বদলি-পদায়ন দেখে মন্ত্রণালয়। কোনো বিশেষ ব্যক্তির তদবিরে এই বদলি হয়েছে কিনা, তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ই ভালো বলতে পারবে।’
যেভাবে স্বাস্থ্যের কেনাকাটা মিঠুর কবজায়
২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালসহ দেশের কয়েকটি হাসপাতালে ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং (এমআরআই) মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সরবরাহে প্রায় দুইশ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর বিরুদ্ধে। মূলত তখনই আলোচনায় আসেন তিনি। এ ঘটনায় তদন্তের পর তদন্ত হয়েছে; কিন্তু কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়নি।
৯০০ কোটি টাকার দুর্নীতি
করোনা মোকাবিলায় মাস্ক, পিপিইসহ সুরক্ষাসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার অনিয়ম এবং দুর্নীতির একটি অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী চক্র এর সঙ্গে জড়িত। অভিযোগ রয়েছে, এই দুর্নীতির মূল হোতা হলেন ঠিকাদার মিঠু। ২০২০ সালে এন-৯৫ মাস্ক কেনাকাটায় ওই দুর্নীতির বিষয়টি প্রথম সামনে আসে। খুলনা ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এন-৯৫ মাস্কের মোড়কে সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করে সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপো (সিএমএসডি) বা কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানানোয় তখন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে পাবনা মানসিক হাসপাতালে বদলি এবং মুগদা মেডিকেলের পরিচালককে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। বিষয়টি তদন্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে; কিন্তু ওই কমিটির প্রতিবেদন এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের একটি সূত্র জানায়, ২০২০ সালে ৬১টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই মিঠু চক্রের। ওই কেনাকাটায় গুরুতর অনিয়ম হওয়ার কথা উল্লেখ করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবর ওই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি দেন সিএমএসডির তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল্লাহ। পরে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্স অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করলেও আজ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মিঠুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে স্ত্রী, ভাই, আত্মীয়
অনুসন্ধানে জানা যায়, মিঠুর নিজের নামে রয়েছে আটটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো– মেক্সিকোর মার্চেন্ডাইজার, টেকনো ট্রেড, মেক্সিকোর আইটি পার্ক লিমিটেড, মেসার্স টেকনো ট্রেড, মেসার্স টেকনো ফিশিং, মেসার্স প্রি-এক্সর, নর্থ এগ লিমিটেড ও নর্থ বেঙ্গল পোলট্রি ফার্ম। মিঠুর স্ত্রী নিশাত ফারজানার নামেও রয়েছে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাঁর বড় ভাই মো. মোকছেদুল ইসলামের নামে রয়েছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। ভাই, ভাবি, ভাগনে ও স্বজন মিলে ৬১টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চালান তারা। সব প্রতিষ্ঠানই মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহের কাজ করে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর মোবাইল ফোন ও প্রতিষ্ঠানের ফোন নম্বরে কল করে সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর ভাই মোকছেদুল ইসলাম এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দুর্নীতি আগে বন্ধ করতে হবে
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে বড় বড় অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটলেও দু-একজন কর্মকর্তাকে বদলি বা ওএসডি করা ছাড়া দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির নেই। এই খাতের দুর্নীতি আগে বন্ধ করতে হবে। তা না করে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর সুফল জনগণ পাবে না।’
যা বললেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘স্বাস্থ্যের কেনাকাটায় নতুন করে কোনো চক্র সক্রিয় হতে দেওয়া হবে না।’ ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।