শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর জাহান বেগম। গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন তিনি। পরে গতকাল শুক্রবার তাকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সামনে স্বাস্থ্য খাতের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর স্বাস্থ্য খাতে দেখা দেওয়া অচলাবস্থা নিরসন এবং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশাজীবী রাজনৈতিক বলয় থেকে স্বাস্থ্য খাতকে মুক্ত করা। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে সুসমন্বিত ব্যবস্থাপনা তৈরি করাও নতুন উপদেষ্টার জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা রাতারাতি সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূর জাহান বেগম। তিনি গতকাল বিকেলে তিনি বলেন, ‘রাতারাতি সব ঠিক করে ফেলা যাবে না, তবে বিশ্বাস করি আমরা পারব।’
স্বাস্থ্য খাত নিঅয়ে তার সরকারের পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘এত তাড়াতাড়ি কিছু বলতে পারব না। একটু সময় লাগবে। একটু সময় দেন আমাদের। মাত্র তো দায়িত্ব নিলাম। স্বাস্থ্য খাতে অনেক চ্যালেঞ্জ। অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। চ্যালেঞ্জ থাকবে। চ্যালেঞ্জ ছাড়া তো জীবন চলবে না। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের চেষ্টা করতে হবে। রাতারাতি সব ঠিক করে ফেলব, এমন কথা বলা যাবে না। তবে আমি বিশ্বাস করি আমরা পারব।’
স্বাস্থ্য খাতে পেশাজীবী রাজনীতি প্রসঙ্গে সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত এ উপদেষ্টা বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে অনেক সমস্যা আছে। আমরা সমস্যা সমাধানের অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করব। সে অনুযায়ী যেটা আমাদের কাছে মনে হবে এই মুহূর্তে করা দরকার, সেটা আমরা আগে করব। আমাদের একটু সময় দেন। ক্রমান্বয়ে আপনাদের কাছে জানাব আমরা কী করব।’
অনিয়ম তদন্তে কমিশন গঠনের পরামর্শ : আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের কারণে স্বাস্থ্য খাতে দেখা দেওয়া অচলাবস্থা নিরসনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটি কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘নতুন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নির্দেশনা জারি করতে পারেন যারা যেখানে যেভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, তারা সেভাবেই থাকবেন। ভয়ভীতিহীনভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। একটা কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশন সব পর্যালোচনা করে দেখবে কোথাও শুধু আওয়ামী লীগ বা স্বাচিপ (স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদ) করার কারণে কেউ পদোন্নতি পেয়েছে কি না, অন্য কারও পদোন্নতি বিঘ্নিত হয়েছে কি না, পদায়নে কোনো অনিয়ম আছে কি না। পর্যালোচনা করে কমিশন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট দেবে। সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে মন্ত্রণালয় ক্রমান্বয়ে বা একই সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব পদোন্নতি থেকে শুরু করে পদায়ন ও নিয়োগ ঠিকমতো আছে কি না, সেগুলো দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এই মুহূর্তে ড্যাব (ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) চাইবে সব প্রতিষ্ঠানে কর্র্তৃত্ব নিতে। এমন সুবিধাবাদিতা আমরা সবসময়ই ড্যাব ও স্বাচিপের সময় দেখেছি। সেটি যেন না হয়। এই মুহূর্ত থেকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে পদায়ন, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। এটা যেন ভবিষ্যতেও চলমান থাকে।’
এ বিশেষজ্ঞ গতকাল গণ্যমাধ্যমে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই দুর্নীতি নানাবিধ ও নানা ধরনের। বিভিন্ন জিনিসপত্র ক্রয়ে দুর্নীতি হয়। হাসপাতাল থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র বাইরে চলে যায়। জিনিসপত্র বেশি দামে কেনা হয়। পুরো স্বাস্থ্য খাতে এসব দুর্নীতি বিরাজিত। এটা শুধু রাজনৈতিক সরকারের কারণে না, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, কেনাকাটা ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাবেও হয়।’
চিকিৎসকদের পেশাজীবী রাজনীতি দেশের সুসমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বড় সংকট বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকসহ চিকিৎসা পেশায় জড়িতদের অবশ্যই পেশাজীবী সংগঠন থাকবে। যেমন বিএমএ থাকবে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হয়ে কোনো পেশাজীবী রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করা, এটা আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বিরাট সমস্যা তৈরি করেছে। পাশাপাশি বিএমডিসি স্বাস্থ্য খাতের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। সেটা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করায় চিকিৎসকদের নৈতিকতার সমস্যা হচ্ছে। আমি মনে করি ড্যাব বা স্বাচিপ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের মতো পেশাজীবী সংগঠন নিরুৎসাহিত করা কিংবা পারলে নিষিদ্ধ করে দিয়ে বিএমএর মতো সংগঠনকে শক্তিশালী করা উচিত।’
আরও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথা বলেন এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তার মতে, ‘বড় চ্যালেঞ্জ বাজেট। বাজেট বরাদ্দ কম হচ্ছে। এর ফলে অনেক কর্মসূচি ঠিকমতো হচ্ছে না। এরপর দীর্ঘদিন সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সব পরীক্ষা বাইরে থেকে করতে হয়। সরকারি হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা দরকার। একই রকমভাবে সরকারি হাসপাতালে রোগীরা ওষুধপত্র, অর্থাৎ মেডিকেল ও সার্জিক্যাল ইকুইপমেন্ট পাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণটাই বাইরে থেকে নিতে হয়। এটার ব্যবস্থা করা। এই কয়েকটা জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
ডা. বে-নজির বলেন, ‘চিকিৎসায় সন্তুষ্ট না হওয়ার কারণে রোগীরা সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি হাসপাতাল ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় রোগীদের সন্তুষ্টি কীভাবে আনা যায় ও ধরে রাখা যায়, সেটা আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ।’
এ ছাড়া ইপিআই বা টিকাদান কর্মসূচি, রোগ নির্মূল কর্মসূচি ও মাতৃ-শিশু মৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জনস্বাস্থ্যের এসব কর্মসূচিকে সচল করা এবং ভবিষ্যতে অব্যাহত রাখা এবারের ও সামনের দিকে বড় চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করেন তিনি।